ছবিও তো নাচ-গানের বাইরে নয়। যথারীতি এখানেও সেই অপরাজেয় পুরুষ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে সুপারস্টার শাহরুখকে। অর্থাৎ নক্ষত্রনির্মাণের চেনা সন্দর্ভ এ ছবির সর্বাঙ্গেই। ছবিতে বেশ কয়েকজন তাবড় নায়িকা কাজ করেছেন। তাঁদের চরিত্ররা কিন্তু বলিউডি নায়িকার প্রোটোটাইপের বিপ্রতীপেই দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ চেনা সমীকরণের ভিতরই খানিক অন্য হাওয়া খেলিয়েছেন পরিচালক এবং চিত্রনাট্যকার।
মাসখানেক আগের কথা। এক ফ্যান জানতে চেয়েছিলেন, ‘জওয়ান’ ছবির চালিকাশক্তি হিসাবে যদি একটি শব্দ বলতে হয়, তাহলে কী বলবেন? কিং খান নির্দ্বিধায় জবাব দিয়েছিলেন, নারী। নারীই এই ছবির চালিকাশক্তি-। বলেছিলেন, ‘it’s a film about women made for men!’ এ ছবিতে লড়াই দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেমের বিরুদ্ধে। আর সে লড়াই যিনি লড়বেন, তিনিই ‘জওয়ান’। শাহরুখ দেখালেন, এই লড়াইয়ের অগ্রভাগে আছেন দেশের নারীরা। ‘জওয়ান’ কি তাহলে নারীকেন্দ্রিক সিনেমা? কোনও কোনও মহলে তা নিয়ে চর্চা হচ্ছে বটে। এই অভিধা আদৌ দেওয়া যায় কি না, তা তর্কযোগ্য। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, শাহরুখের ছবি যেভাবে নারী চরিত্রকে গুরুত্ব দিয়েছে, এবং গল্পের পরতে পরতে সিস্টেমকে যেভাবে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন নারীচরিত্ররা, তা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে বইকি।
আরও শুনুন: চিকিৎসায় দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার, ‘জওয়ান’ শাহরুখকে ধন্যবাদ জানালেন সেই ডাঃ কাফিল খান
এই ফিল্ম-দুনিয়া নারীকে পণ্য করে। এ অভিযোগ নতুন কিছু নয়। এবং তার সারবত্তাও আছে। নায়কপ্রধান সিনেমা মূলত নায়িকাকে বিনোদনের সামগ্রী ছাড়া বিশেষ আর গুরুত্ব দিতে নারাজ। অতএব মেইল গেজ নির্ধারিত নারীর আদর্শ হয়েই নায়িকাদের পর্দার সামনে আসতে হয়। সিনেমার গল্প যে বিষয় নিয়েই ব্যস্ত থাকুক না কেন, মূলত তা পুরুষতন্ত্রের উদযাপন হয়েই দাঁড়ায়। এই সব ছবিতে স্টারের যে নক্ষত্রদ্যুতি ছড়িয়ে সেখানে নারীর গুরুত্ব প্রায় ম্লান। এই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে বহুদিন। ক্রমে সময় বদলেছে। এই গড় ধারণারও বদল এসেছে। নারীকে মুখ্য করেও নানা ছবি তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এরকম অনেক ছবি নিয়েই আলোচনা হয়েছে। নারীকে স্টার হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে একাধিক ছবিতে। তবে, পুরুষপ্রধান স্টার-সিস্টেমের ভিতরে বসেও যে নারীকে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেওয়া যায়, শাহরুখের ছবিতে তা বারেবারে উঠে এসেছে। সিনে-তাত্ত্বিকরা বলেন, পুরুষপ্রাবল্যের যে উদযাপন এই ফর্মূলা-বাঁধা সিনেমায় চলে, তার সমান্তরাল একটা বয়ান তৈরি করতে পেরেছে শাহরুখের অভিনীত চরিত্ররা। পুরুষের চোখে জল মানায় না, এমন ক্লিশে ধারণাকে বাউন্ডারির ওপারে পাঠিয়ে একের পর এক ছবিতে দেখা গিয়েছে সুপারস্টারের চোখে জল। নারীর সম্মতিকে গুরুত্ব দিলে সুপারস্টারের আলোকজ্যোতি যে ম্লান হয় না, তা বহুবার বুঝিয়েছে শাহরুখ অভিনীত চরিত্ররা। সেই ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’ বা ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’-এর মতো ছবিতে যখন একেবারেই প্রেমিক চরিত্রে দেখা যেত শাহরুখকে, তখন থেকেই এই নির্মাণের শুরু। পরবর্তী সময়ে ‘চাক দে ইন্ডিয়া’ থেকে ‘ডিয়ার জিন্দেগি’র মতো ছবিতে দেখা গেল, শাহরুখের সুপারস্টারডমের পাশেও পর্যাপ্ত গুরুত্ব পাচ্ছে নারীচরিত্ররা। কখনও আবার নারীচরিত্রই ছবিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এই ঘরানায় উল্লেখযোগ্য সংযোজন বলা যেতে পারে সাম্প্রতিক ‘জওয়ান’ ছবিটিকে।
আরও শুনুন: শাহরুখ মানেই হারানো স্বদেশ, নিরুদ্দেশের উদ্দেশে আমাদের ব্যক্তিগত ঘোষণা
এ ছবি সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ জানায়। হয়তো অতিনাটকীয় ভঙ্গিতেই, তবু বার্তা খুবই স্পষ্ট। আর সেই বার্তাবাহক কেবলমাত্র শাহরুখের চরিত্র বিক্রম বা আজাদ নন। সেখানে নারীরাই অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছেন। ছবির এক মোক্ষম জায়গায় ইরানি চরিত্রটিকে বলতে শোনা যায়, ‘কুছ নেহি কর সাকতা তু, মেরে আদমি হ্যায় ইস্ জেল মে’। জবাবে শাহরুখ বলেন, ‘হাঁ জেল মে আদমি তেরে হ্যায়, পার ইয়ে জেল মেরে অওরতোঁ কা হ্যায়’। নিছক একটা হাততালি পাওয়া ডায়লগ হিসাবেই এটিকে দেখা যেত। বাধ সাধছে ছবির নির্মাণই। যে ক্রুসেড শাহ্রুখ অভিনীত চরিত্রটি করছে, সেখানে যোদ্ধা হয়ে সামনের সারিতে উঠে এসেচেন কয়েকজন নারীই। এই লড়াইয়ে আছেন সেই কৃষককন্যা, যাঁর বাবাকে আত্মহত্যা করতে হয়েছে ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে। আছেন সেই মহিলা চিকিৎসক, যিনি সিস্টেমের সোষারোপের বলি হয়েছেন। এই নারী চরিত্ররা সকলেই জেলে বন্দি। এই বন্দিত্ব প্রতীকী হয়ে ওঠে। সিস্টেম তার পৌরুষের আস্ফালনেই নারীকে গরাদের আড়ালে বন্দি করছে। সেই বন্দিত্বকে মিথ্যে করেই নারীরা লড়াই করছেন যা ক্রমে হয়ে উঠছে এই আরোপিত বন্দিত্বের বিরুদ্ধেই প্রতিস্পর্ধী এক লড়াই। কারাগারই এখানে হয়ে উঠছে লড়াইভূমি। কারাগারের ভেতরে তৈরি হচ্ছে নকশা। মহিলা জেলেরও এক নতুন চেহারা দেখানো হয়। মহিলারা এখানে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী নন, বরং তাঁরা এক লক্ষ্যে স্থির। এমনকী ভবিষ্যতে যে আজাদ বিদ্রোহী হয়ে উঠবে, তাকেও লালন-পালনের দায়িত্ব নিয়েছেন এই বন্দি মহিলারাই। ছবিতে দীপিকা অভিনীত চরিত্ররা খুদে আজাদকে এই নারীদের কথাই আলাদা করে বলে দিয়ে যায়। আজাদ বড় হয়ে সেই মহিলাদ যোদ্ধাদের নিয়েই সিস্টেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। এমনকী শেষে যখন দুষ্টের দমন হয়, তখনও একজোট হয়ে এগিয়ে আসেন নারী চরিত্ররাই। অর্থাৎ,পরিত্রাতা হিসাবে শাহরুখ যতই থাকুন না কেন, ন্যায়ের এই লড়াইয়ে নারীশক্তিই প্রধান হয়ে উঠছে।
তবে কথা হল, এ ছবিও তো নাচ-গানের বাইরে নয়। যথারীতি এখানেও সেই অপরাজেয় পুরুষ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে সুপারস্টার শাহরুখকে। অর্থাৎ নক্ষত্রনির্মাণের চেনা সন্দর্ভ এ ছবির সর্বাঙ্গেই। ছবিতে বেশ কয়েকজন তাবড় নায়িকা কাজ করেছেন। তাঁদের চরিত্ররা কিন্তু বলিউডি নায়িকার প্রোটোটাইপের বিপ্রতীপেই দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ চেনা সমীকরণের ভিতরই খানিক অন্য হাওয়া খেলিয়েছেন পরিচালক এবং চিত্রনাট্যকার। বিশেষত শাহরুখের মতো সুপারস্টারের সিনেমাতে গল্পে এবং গল্প পেরিয়ে নারীদের যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তার তাৎপর্য একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাস্তবিকই দেখা যায়, শাহরুখের ছবির সূত্রেই অনেক নায়িকাই তাঁদের কেরিয়ার শুরু করেছেন। যত দিন গড়িয়েছে পুরুষপ্রধান ইন্ডাস্ট্রিতে নিজেদের আসন পাকা করেছেন তাঁরা। এই নিরিখে শাহরুখের ছবিগুলোকে পাশাপাশি রাখলে একরকমের ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়। যার চূড়ান্ত বিন্দু বলা যেতে পারে ‘জওয়ান’ ছবিটিকে। যেখানে নারী চরিত্রেরা অভিনেতারা নিছক শাহরুখের নায়িকা হয়ে থেকে যাননি, বরং হয়ে উঠেছেন সহ-অভিনেতা। মাস মুভিতে নারীর এই অবস্থান হয়তো সামগ্রিক ভাবে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিরই এগিয়ে যাওয়ার পদচিহ্ন। ‘জওয়ান’ ছবির অনেক রাজনৈতিক কথার ভিতর এই রাজনৈতিক বার্তাটিও বেশ স্পষ্ট হয়েই ধরা থাকল।