স্ট্যালিনপুত্র উদয়ানিধির মন্তব্যে শোরোগোল গোটা দেশের রাজনীতিতে। প্রত্যাশিত ভাবেই তাঁর মন্তব্যকে হাতিয়ার করে ময়দানে ঝাঁপিয়েছে গেরুয়া শিবির। দেশের অন্যান্য রাজনীতিবিদরাও যেন খানিকটা দূরত্বই বজায় রেখেছেন তরুণ নেতার ধর্ম সংক্রান্ত সেই মন্তব্য থেকে। তবে, উদয়ানিধি বা প্রিয়াঙ্ক খাড়গেরা কিন্তু সাহস করে খুব গূঢ় প্রশ্নই তুলছেন। কোন দিকে তাঁদের আঙুল? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
উদয়ানিধি ( Udhayanidhi Stalin )যেভাবে ধর্মকে রোগ-ব্যাধির সঙ্গে তুলনা করেছেন, তা কি কাম্য? এক কথায় এর উত্তর নাই-ই হবে। দেশের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদরাও সেই কথাই বলছেন। তাঁদের মতে, এই মতবাদ একান্তই তরুণ রাজনীতিবিদের ব্যক্তিগত। তার সঙ্গে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের মতাদর্শগত কোনও মিল নেই।
আরও শুনুন: ৯ বছরে কদিন ছুটি নিয়েছেন মোদি? জবাব দিল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর
এ-পর্যন্ত সব ঠিকই আছে। তবে, আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের কথাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। উদয়ানিধি যখন প্রবল সমালোচনার মুখে, তখন ধর্ম নিয়ে আরও সাহসি মন্তব্য করেছেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের ছেলে প্রিয়াঙ্ক খাড়গে। তাঁর বক্তব্য, যে কোনও ধর্ম যা সাম্যের কথা বলে না, যে ধর্ম মানুষকে মানুষ হিসাবে মর্যাদা দেয় না, তা ধর্ম হতে পারে না। যদি কোনও ধর্ম এর অন্যথা করে থাকে, তবে তা অসুখেরই নামান্তর।
আপাত ভাবে মনে হতে পারে, দুই তরুণ রাজনীতিবিদই হয়তো ধর্ম-বিদ্বেষী। অন্তত গেরুয়া শিবিরের প্রচার তাঁদের সেভাবেই তুলে ধরতে ব্যস্ত হবে। ইতিমধ্যে প্রবল সমালোচিত হচ্ছেন উদয়ানিধি। তবে, শুধুমাত্র ব্যক্তিগত মতবাদ বলে এই দুই তরুণের ভাবনাকে সীমায়িত করে রাখা যায় না। বরং ভাবা উচিত, ঠিক কোন পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে দুই তরুণ রাজনীতিবিদের এই ধরনের ভাবনার জন্ম হয়েছে।
ধর্ম নির্মূল করা যায় না। অতীতকাল থেকে যে জ্ঞানের প্রবাহ সভ্যতাকে ধরে রেখেছে, আজও যার ভিতর সভ্যতার বেগবতী হওয়ার মন্ত্র নিহিত, তাকে মুছে ফেলার অর্থ নিজেদের অস্তিত্বকেই সংকটের মুখে ফেলে দেওয়া। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্মের সেই আত্মদর্শনের প্রতি আমরা আজ কতখানি নিষ্ঠ? বেদ বা বেদান্ত যেভাবে আপনাকে জানার কথা বলে, আমাদের পুরাণ-মহাভারত যেভাবে ন্যায়-নীতির ডিসকোর্সের পথে আমাদের চালিত করে বা সেই অভিমুখ চিহ্নিত করে দেয়, আজ কি আমরা সত্যিই ধর্মকে সেভাবে দেখি? এর উত্তরে নাই-ই বলতে হয়। বরং ধর্ম ও রাজনীতি মিশে গিয়ে যে পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে প্রতিদিন লাঞ্ছিত হয় মানুষ। ধর্মের ব্যাখ্যা খুব ভাল জিনিস, তবে তার অপব্যাখ্যা যে বিষাক্ত পরিবেশের জন্ম দিতে পারে, তা আজ আমাদের অজানা নয়। এবং একান্তে স্বীকার করতেই হয় যে, সেই বিষবাষ্পে বর্তমান সভ্যতার আজ শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যে আখেরে দেশের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছে, হয়তো সেই কথাটাই সোচ্চারে বলতে চাইছেন রাজনীতিবিদদের তরুণ প্রজন্ম। তাঁরা যে ধর্মকে সম্মান করেন না, এ কথা বলছেন না। কিন্তু ধর্মের যে ব্যাখ্যা মানুষকে অপমানিত করছে, আর যাঁরা তা করার চেষ্টা করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহী এই ত্রুণ প্রজন্ম।
আরও শুনুন: ভোট টানতে ভরসা মোদি, তাই কি জোর ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ নীতিতে?
বহুদিন আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর চণ্ডালিকা-য় প্রকৃতির মুখে রেখেছিলেন এই সারসত্য, যে, ‘যে-ধর্ম অপমান করে সে-ধর্ম মিথ্যে’। তরুণ রাজনীতিবিদদের মন্তব্যের ভাষা নিয়ে সমালোচনার অবকাশ আছে। তবে তাঁদের ভাবনার সুতোয় যেন ফিরে এল সেই রবীন্দ্র-অনুভবই। হয়তো রাজনীতির চক্রে দুই তরুণ নেতার মন্তব্য ক্রমে হারিয়ে যাবে। তবে তরুণের চিন্তা যেন দেশবাসীকেই দিয়ে গেল নতুন ভাবনার রাস্তা। সমালোচনার পাশাপাশি সকলের সামনেই খোলা থাকল সেই ভাবনার অবকাশও।