নিষ্ঠাভরে ব্রত পালন করলে পূর্ণ হয় মনস্কামনা। আর তাই ব্রত-উপবাসের প্রতি মন দেন বহু ভক্ত। কেউ কেউ তো এতই কঠোর যে, নির্জলা উপবাস পর্যন্ত পালন করেন। এই যে ব্রত-উপবাসের দরুন আমাদের মনের বাসনা পূর্ণ হচ্ছে, এই কি তবে ঈশ্বরলাভ?
আমাদের কোনও একটা কামনা পূরণের জন্যই তো আমরা দেবতাদের শরণ নিচ্ছি। ব্রতপালনের গুণে তিনি তা পূরণ করেও দিচ্ছেন। তাতে সেই অপ্রাপ্তির শূন্যস্থান ভরাট হচ্ছে বটে। তবে, আদৌ কি আমরা ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাচ্ছি? এ প্রশ্ন সঙ্গত। কেন-না ঈশ্বরলাভই আমাদের একমাত্র অভীষ্ট। তা সম্ভব হলে, আর কোনও অভাবই থাকে না। জীবন আনন্দ-জ্যোতিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে। এদিকে একটি ব্রত পালনে হয়তো একটি মনোবাসনা পূর্ণ হয়। আবার পর মুহূর্তেই জেগে ওঠে অন্য অভাববোধ। তখন আবার অন্য ব্রত পালন করতে হয়। অর্থাৎ ব্রত পালনেই যে ঈশ্বরলাভ হচ্ছে তা কিন্তু নয়।
আরও শুনুন: পৃথিবী নাকি ঘুরছে না! পাক যুবকের আজব দাবিতে হাসির রোল নেটপাড়ায়
এই কথাটিই প্রাঞ্জল ভাবে শ্রীগীতায় বলে গিয়েছেন স্বয়ং ভগবান। জ্ঞান-বিজ্ঞান-যোগ অধ্যায়ের ২০ থেকে ২৩ নম্বর শ্লোক জুড়ে অর্জুনকে তিনি বুঝিয়েছিলেন, সকাম সাধনায় ঈশ্বর লাভ হয় না।
কামৈস্তৈস্তৈর্হৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেহন্যদেবতাঃ।
তং তং নিয়মমাস্থায় প্রকৃত্যা নিয়তাঃ স্বয়া।।
অর্থাৎ, স্ত্রী-পুত্র ধনমানাদি বিভিন্ন কামনার দ্বারা যাঁদের বিবেক অপহৃত হয়েছে, কামনা-কলুষিত স্বভাবের দ্বারা বশীভূত হয়েছেন যাঁরা, তাঁরা ক্ষুদ্র দেবতার আরাধনায় ব্রত-উপবাস ইত্যাদির যে সমস্ত নিয়ম আছে, তা পালন করে অন্য দেবতার ভজনা করে থাকেন। অর্থাৎ ঈশ্বর স্বয়ং এখানে বলছেন যে, কামনার দ্বারা চালিত যাঁরা, তাঁরা পরমরূপ ঈশ্বরকে ভজনা করেন না। তবে কি এই অন্য দেবতাদের ভজনা করা উচিত নয়? না, সে কথা তিনি বলছেন না। বরং বলছেন, যাঁর যে দেবতায় ভক্তি, তিনি নিজেই ভক্তের সেই ভক্তিকে সেই সেই দেবতার মুর্তিতে অচলা করে দেন। ভক্ত তাঁর আরাধ্য দেবতার থেকে তখন কাম্যবস্তু লাভ করে থাকেন। এ-ও তাঁরই ইচ্ছে, কেননা এই দেবতারাও তাঁরই অঙ্গস্বরূপ।
আরও শুনুন: ‘কালো মেয়ে’র গায়ের রং সবুজ! কী গল্প লুকিয়ে এই বিগ্রহের নেপথ্যে?
তবে এই কথাগুলি বলার উদ্দেশ্য হল, এইভাবে সকাম সাধনায় দেবতাদের থেকে কাম্য বস্তুটি নয় অর্জন করা গেল, তাতে কিন্তু ঈশ্বরলাভ হল না। বলা যেতে পারে, ঈশ্বরই তো কৃপা করে এসব দিচ্ছেন। তাহলে আবার অন্য কথা তিনি বলছেন কেন? বলছেন এই কারণে যে, সকাম সাধনায় যে ফললাভ হয়, তা বিনাশশীল। তা চিরস্থায়ী নয়। এবং দেবতাদের উপাসকরা দেবলোক প্রাপ্ত হন বটে, তবে ঈশ্বরকে পান না। পরমে লীন হয়ে যেতে পারেন না তাঁরা। তাঁর প্রকৃত ভক্তরা ঈশ্বর ব্যতীত আর কোনও কিছু চান না। আর তাই ঈশ্বরের ভক্তরা তাঁকেই লাভ করে থাকেন।
এই তত্ত্ব আমাদের জানিয়ে দেয়, ঈশ্বর আমাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করছেন মানেই আমাদের ঈশ্বরলাভ হচ্ছে না। কঠোর ব্রত-উপবাসে যদি কামনা মিশে থাকে, তবে তা ঈশ্বরলাভের পরিপন্থীই।