চাঁদের দক্ষিণ মেরু স্পর্শ করেছে ‘চন্দ্রযান ৩’। দেশের এই অভাবনীয় সাফল্যের শরিক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ও। ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম মাটিতে মিশেছিল, তাই-ই যেন খানিকটা ফিরে এল কৃতী প্রাক্তনীদের হাত ধরে। মর্মান্তিক একটি ঘটনার দরুন কি তাহলে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতিত্ব মুছে যেতে পারে? উঠল সে প্রশ্নও। আসুন শুনে নিই।
বিজয় দাই, কৃশানু নন্দী, অনুজ নন্দী- ইসরোর তিন কৃতী বাঙালি বিজ্ঞানীর নামই এখন জানে গোটা বাংলা। ‘চন্দ্রযান-৩’-এর সাফল্যের নেপথ্যে বঙ্গের যে কুশীলবরা আছেন, তাঁদের মধ্যে এঁরা অন্যতম। এঁদের আরও একটি সাধারণ যোগসূত্র আছে। সেটি হল, তিন কৃতীর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। শুধু তা-ই নয়। এই যে চন্দ্রযান প্রকল্প, সেটির সঙ্গেও বেশ নিবিড় যোগাযোগ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের। ‘চন্দ্রযান-৩’-এর অবতরণের যে প্রক্রিয়া, তা কীভাবে সম্ভব হতে পারে, তা নিয়ে দেশের বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছিল গবেষণার দায়িত্ব। সেই তালিকায় ছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ও। প্রতিষ্ঠানের ইলেকট্রনিক্স এবং টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক সায়ন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এই অবতরণ প্রকল্প সংক্রান্ত গবেষণার নেতৃত্বে।
আরও শুনুন: প্রার্থনায় এক মন্দির থেকে মাদ্রাসা, ‘চন্দ্রযান-৩’ যেন ফেরাল সম্প্রীতির সেই আবহমান ভারতবর্ষ
অর্থাৎ চন্দ্রযানের যে সাফল্য উদযাপন করছে গোটা দেশ, সেখানে যথেষ্ট অবদান ছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের। আপাত দৃষ্টিতে এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং রাজ্যের প্রথম সারির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধা যে দেশের মেধাবী প্রকল্পে জড়িত থাকবে, তাতে আশ্চর্যের কী আছে! তাহলে আজ আলাদা করে যাদবপুরের কৃতিত্বের উল্লেখের প্রয়োজন পড়ছে কেন? পড়ছে, কেননা মর্মান্তিক ঘটনায় নাবালক ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় প্রায় মাটিতে মিশেছিল প্রতিষ্ঠানের সুনাম। যে ঘটনা সেখানে ঘটেছে তাতে রীতিমতো স্তম্ভিত সারা রাজ্য। এতবড় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বপ্নের এমন অপমৃত্যু ঘটতে পারে কী করে! প্রশ্ন ওঠা কিন্তু অসঙ্গত নয়। যে দুষ্টচক্র এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্ত করতে হবে, এ নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশই নেই। ভবিষ্যতে আর একটি পড়ুয়ার সঙ্গেও যাতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব যেমন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের, তেমন সামগ্রিক ভাবে এ রাজ্যের সকল নাগরিকেরও। এ নিয়ে দ্বিমত হওয়ার জায়গাই নেই।
আরও শুনুন: চর্চায় সিনেমার হিরো, বাস্তবের মহাকাশচারী রাকেশ শর্মা এখন কোথায়?
তবে এই ঘটনার সূত্র ধরেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে হীন করে দেখানোর যে অপচেষ্টা হচ্ছিল, তা-অ ক্রমাগত ভাবাচ্ছিল শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে। ক্রমাগত এই ছবিই তুলে ধরা হচ্ছিল যে, বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি উচ্ছৃঙ্খলতার আখড়ায় পরিণত হয়েছে। যেন সেখানে বিদ্যাচর্চার স্রোতটি বহুদিন হল শুকিয়ে গিয়েছে। যা পড়ে আছে তা হল কতিপয় পড়ুয়ার বেয়াদপি। সত্যিই কি যাদবপুর বিশ্বাবিদ্যালয় মানে শুধু সেটাই? এ প্রশ্নের সামনে দাঁড়ানোর প্রয়োজন আছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই বেশ কয়েকজন পড়ুয়া জঘন্য অপরাধ করেছে। পুলিশ-প্রশাসনের নিয়মেই তারা শাস্তি পাবে। সেই শাস্তির দাবি করছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েরই অন্যান্য পড়ুয়াড়াই। কিন্তু তাঁদের সেই প্রতিবাদের স্বরটিকে চাপা দেওয়ার একটি জোরালো চেষ্টা ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল গত কয়েকদিনে। বরং যেন অতিসরলীকরণ করে অপরাধী ছাত্রদের সঙ্গেই মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছিল যাদবপুরের বাকি প্রায় পনেরো হাজার পড়ুয়াকেও। এমনটা তো হতে পারে না। যে দেশে আমরা বাস করি, সেখানেও বহু অপরাধীর দেখা মেলে। সেই সব অপরাধ আমাদের স্তম্ভিত করে। আইনের পথ ধরে সেই অপরাধীদের যথাবিহিত শাস্তিও হয়। তবে, অপরাধী আছে বলেই গোটা দেশটির বাকি গৌরব তো মিথ্যে হতে পারে না। যাদবপুরের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, যাদবপুরের অন্ধকার দিক তুলে ধরার তাগিদে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক ঐতিহ্যটিকেই ধূলিসাৎ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল জোর কদমে। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে যে ভারচুয়াল হেনস্তার শিকার হলেন যাদবপুরের প্রাক্তন ও বর্তমান পড়ুয়ারা, তা-ও একরকম র্যাগিং-এরই নামান্তর। সচেতন নাগরিক হিসাবে যাদবপুরের ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করা নিশ্চিতই সঙ্গত। কিন্তু তা কি একটি সামগ্রিক প্রতিষ্ঠানকে হীন প্রতিপন্ন করতে পারে! বারেবারে এই কথাটিই বলার চেষ্টা করছিলেন রাজ্যের এক শ্রেণির নাগরিক। যদিও তাঁদের সেই ক্ষীণ কণ্ঠস্বরকে চাপা দিয়েই চলছিল যাদবপুরের সুনামহানির নিষ্ঠুর উল্লাস।
ঠিক সেই আবহেই চন্দ্রযানের সাফল্যে ভাসল গোটা দেশ। আর সেখানে অবধারিত ভাবে উঠে এল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। নতুন করে বলার নয়, তবু গত কয়েকদিনের প্রেক্ষিতেই তাই নতুন করে বলতে হচ্ছে যে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় মানেই কেবল রসাতলের রাস্তা নয়, যথেচ্ছাচারের স্বর্গরাজ্য নয়। বরং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় মানে মেধাচর্চা শীর্ষবিন্দু ছোঁয়ার স্পর্ধা। জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার মেধাবী পরিসর। এই সত্যটিকে অস্বীকার করলে আসলে নিজেদের গৌরবকেই ক্ষুণ্ণ করি আমরা।
আরও শুনুন: চন্দ্র-অভিযানে দিয়েছিলেন মূল্যবান পরামর্শ, ঐতিহাসিক মুহূর্তে ফিরল আব্দুল কালামের স্মৃতি
নাহ্, অপরাধ ও অন্যায়কে কখনোই সমর্থন করা যায় না। পাশাপাশি অন্যায়ের প্রতিবাদ একটি প্রতিষ্ঠানকে সামগ্রিক ভাবে ছোট করার মানসিকতাতেও পর্যবসিত হতে পারে না। চন্দ্রযানের সাফল্যে যাদবপুরের প্রাক্তনীদের কৃতিত্ব যেন নীরবে একটি কথাই বলতে চাইল, একটি কালো ঘটনায় প্রতিষ্ঠানের সমস্ত আলো নিভে যেতে পারে না। অপরাধী শাস্তি পাক, অন্যায় দূর হোক। বিশ্ববিদ্যালয় তার দুর্বল জায়গাগুলো অতিক্রম করে সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে উঠুক। অন্যায়ের প্রতিবাদ নিশ্চিতই জরুরি। প্রশ্ন তোলাও জরুরি। তবে প্রতিবাদের পথ যেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে আমাদের ঐতিহ্যকে নিয়েই এক্কাদোক্কা না খেলে! এই কথাটুকু মনে রাখলে আমাদের লাভ বই ক্ষতি নেই!