কখনও মুসলিম, কখনও গ্রিক, কখনও ফরাসি, কখনও ব্রিটিশ, বারবার বহিরাগত শক্তিরা হানা দিয়েছে এ দেশে। দখল করে নিয়েছে ভূখণ্ড। কিন্তু উলটোদিকে, এ দেশের রাজারা নাকি ভিনদেশ দখলের পথে হাঁটেননি কখনও। সে দাবির প্রেক্ষিতে কী জানায় ইতিহাস? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
ভারত শান্তির দেশ। এ দেশে বহিরাগত শত্রুর হামলা হয়েছে বারবার, যার ফল দীর্ঘদিনের মুসলিম শাসন, তারপর ব্রিটিশ শাসন। কিন্তু মুসলিম শাসন শুরু হওয়ার আগে, ভারতের রাজারা নাকি ভিনদেশ দখলের লড়াইয়ে নামেননি কখনোই। বাইরে থেকে এসে মুসলিমদের ভারত জয়ের সঙ্গে তুলনা করে এমন কথা বলে থাকেন অনেকেই। দাবি করে থাকেন, ভারতের রাজারা রক্তলোলুপ যুদ্ধবাজ ছিলেন না। কিন্তু ইতিহাস কি এই দাবিকে মান্যতা দেয় আদৌ? শোনা যাক সে কথাই।
আরও শুনুন: মুসলিম বা ব্রিটিশ আমলে নয়, হিন্দু রাজাদের সময়েই কি বেশি ধনী ছিল দেশ?
একসময় গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার বিশ্বজয়ের লক্ষ্যে বেরিয়ে ভারতের কিছু অংশ দখল করে নিয়েছিলেন। পুরু-র সঙ্গে যুদ্ধের সেই বিখ্যাত গল্প তো আমাদের সকলেরই জানা। কিন্তু দখলদারির গল্প এখানেই শেষ হয়নি। তেরো শতকের শুরুতেই কৌশলে লক্ষ্মণ সেনকে সরিয়ে বাংলার মসনদ ছিনিয়ে নিল তুর্কিরা। গোটা ভারত জুড়েই চলল দীর্ঘ মুসলিম শাসন, যার অবসান হল ব্রিটিশদের কাছে অন্যায় যুদ্ধে হেরে গিয়ে। এরপর ফের ২০০ বছরের জন্য পরাধীনতা বয়ে চলতে হয় এ দেশকে। কিন্তু কথা হল, ভারত কি কেবল পরাধীনতার জ্বালাই সহ্য করেছে? নাকি অন্য কোনও দেশকে পরাধীন করে রাখার দায়ও তার উপরে বর্তায়? চলতি বিশ্বাস যতই উলটো কথা বলুক না কেন, ইতিহাস কিন্তু তেমনটাই বলছে। একে তো প্রথমদিকে ভারত ছোট ছোট একাধিক অঙ্গরাজ্যে বিভক্ত ছিল। সেই রাজ্যগুলির মধ্যে যুদ্ধবিবাদ লেগেই থাকত। সুযোগ বুঝে একে অন্যের রাজ্য দখল করে নেওয়াও চলত। এমনকি আরও পরে, পাল বংশের আমলেও দেখা যায়, মগধের রাজা বিগ্রহপালের রাজত্ব প্রায় দখল করে বসেন বঙ্গালের রাজা জাতবর্মা। কেবল দেশের মধ্যেই এই দখলদারি চলত এমনটা নয়। শ্রীলঙ্কার একটি মধ্যযুগের পুথি জানাচ্ছে, চোল রাজারা একসময় দখল করে নিয়েছিলেন এই এলাকা। চোল রাজা প্রথম রাজেন্দ্রর লিপিতেও এই বক্তব্যের সমর্থন মেলে। গুপ্ত আমলে কালিদাস তাঁর রঘুবংশে লিখছেন, পারসিকদের দাড়িওয়ালা মাথা কেটে ফেলে তাদের রাজ্য জয় করছেন রাজা রঘু। তাঁর আক্রমণের সামনে পরাস্ত হচ্ছে হুন ও আফগানরাও। গবেষকরা মনে করছেন, তাঁর আমলে কোনও রাজা যুদ্ধবিগ্রহ না করলে এই কল্পনার রসদ পেতেন না কবি। এমনকি ১২ শতাব্দীতে লেখা কলহনের ‘রাজতরঙ্গিণী’-ও জানাচ্ছে, দিগবিজয়ে বেরিয়েছিলেন কাশ্মীর রাজ ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়। সেকালের ঐতিহাসিক নিদর্শন থেকে আরও জানা যায়, রাষ্ট্রকূটরা হিমালয়ের কাছাকাছি অঞ্চল, ওড়িশা, গুজরাট ও তামিলনাড়ুতে আক্রমণ চালিয়েছিল। বাংলা ও কর্ণাটকের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা এবং ইন্দোনেশিয়াতে হানা দেন চোল শাসকেরা। পাঞ্জাব, আফগানিস্তান এবং চিনের এক অঞ্চলে অভিযান চালিয়েছিলেন কাশ্মীরের রাজারা।
আরও শুনুন: ভারতে যারা জন্মায় তারা সবাই হিন্দু, গুলাম নবি আজাদের দাবিতে শোরগোল নেটদুনিয়ায়
এই সব কিছু বিচার করলে বলাই যায়, কেবল মুসলিমরাই যুদ্ধ করে অন্য দেশ দখল করেছে, এমনটা নয়। একই কাজ করেছেন মুসলিম আমলের আগেকার ভারতের শাসকরাও। সত্যি বলতে, যিনি রাজা, তিনি একদিকে যেমন বাইরের শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে চাইবেন, তেমনই নিজের রাজত্বও আরও বাড়াতে চাইবেন, এমনটা হওয়া তো অস্বাভাবিক নয়। এই ভারতেই একসময়ে ‘রাজচক্রবর্তী’ সম্রাটের ধারণা ছিল, অর্থাৎ যিনি বিপুল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। সুতরাং হিন্দু রাজাদের মধ্যে পরদেশ আক্রমণের কোনও অভ্যাস ছিল না, এমনটা বললে কিন্তু ইতিহাসকেই অস্বীকার করা হয়।