সেই নারীর যৌনাঙ্গে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল দু’বাটি লঙ্কাবাটা। যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন তিনি, আর তা দেখে হাসছিল ব্রিটিশ পুলিশেরা। তবুও একটি গোপন কথাও বলেননি ননীবালা দেবী। বাল্যবিধবা এক সাধারণ নারী তিনি, সেই তিনিই হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম মহিলা রাজবন্দি। আসুন, শুনে নেওয়া যাক তাঁর কথা।
বিয়ে হয়েছিল মাত্র ১১ বছর বয়সে। পাঁচ বছর যেতে না যেতেই বিধবা। সেটা ১৯০৪ সাল। মেয়েদের জন্য সে সমাজে টানা হাজারও নিয়মকানুন। যতই বিধবাবিবাহ আইন পাশ হোক না কেন, মফস্সলের সাধারণ ব্রাহ্মণ পরিবারের সেই বাল্যবিধবার জীবনে বিশেষ হেরফের ঘটেনি। কিন্তু সেই মেয়েকেই কিনা একদিন দেখা গেল মাথাভর্তি সিঁদুর পরে, ঘোমটা টেনে বেরোতে। নাহ, নিজের ব্যক্তিগত সুখের জন্য এমনটা সাজেননি তিনি। এ সাজ দেশের জন্যই। জেলবন্দি বিপ্লবী রামচন্দ্র মজুমদারের স্ত্রী সেজে প্রেসিডেন্সি জেলে ঢুকেছিলেন সেই সাধারণ মেয়েটি। একটি মাউজার পিস্তল কোথায় লুকিয়ে রাখা আছে, সে খোঁজ দিতে পারেন একমাত্র রামচন্দ্রই। আর সেই সংগ্রামের দিনে একটি হাতিয়ারের মূল্যই বিপ্লবীদের কাছে অনেক। তাই সেদিন অসাধ্য সাধন করেছিলেন সেই মেয়েটিই।
আরও শুনুন: গৃহবধূ থেকে বিপ্লবী, অস্ত্র আইনে প্রথম সশ্রম কারাদণ্ড হয় দুকড়িবালা দেবীর
নাম তাঁর ননীবালা। দাম্পত্য সুখ জীবনে জোটেনি। ইচ্ছে ছিল পড়াশোনার, কিন্তু সেখানেও বাধ সাধল রক্ষণশীল বাপের বাড়ি। তখনকার দিনে শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে আসা মেয়ে মানেই ছিল গলগ্রহ। কিন্তু সামাজিক অনুশাসনের থেকে কর্তব্যকেই এগিয়ে রেখেছিলেন ননীবালা। আর তাঁর কাছে সে কর্তব্য হল দেশের কাজ। সম্পর্কে ভাইয়ের ছেলে বিপ্লবী অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে বিপ্লবের দীক্ষা নিয়েছিলেন তিনি। তিনি বিপ্লবীদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতেন, নেতাদের নির্দেশ ও সংগৃহীত অস্ত্রশস্ত্র অন্য জায়গার বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দিতেন গোপনে। পলাতক বিপ্লবী অমর চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর কয়েকজন সহকর্মীকে রিষড়ায় প্রায় দুই মাস আশ্রয় দিয়েছিলেন তিনি। এদিকে অমর পালালেও পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন রামচন্দ্র। তাঁর থেকে পিস্তলের খোঁজ আনার জন্যই জেলে ঢোকার ওই দুঃসাহসিক পরিকল্পনা করেছিলেন ননীবালা দেবী। কেবল পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ই তো নয়, সমাজের কাছে অপমানিত হওয়ার ভয়ও। সেদিনের সমাজে যা কেউ কল্পনা করতেও পারত না তাই করলেন ননীবালা দেবী। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পিস্তলের সন্ধান জেনে বেরিয়ে এলেন প্রেসিডেন্সি জেল থেকে।
পুলিশের নজর এড়িয়ে বিপ্লবীদের আশ্রয়ের জন্য ফের বাড়ি ভাড়া নেওয়া হল। কিন্তু মেয়েরা না থাকলে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ফের মুশকিল আসান হলেন সেই ননীবালা দেবী। গৃহকর্ত্রীর বেশে বিপ্লবীদের আগলে রাখলেন তিনি। যে বিপ্লবীদের একেকজনের মাথার দাম হাজার হাজার টাকা বলে ঘোষণা করেছে পুলিশ। কিন্তু বেশিদিন ননীবালা দেবীর পরিচয় গোপন রইল না। সুতরাং এবার পালাতে হল ননীবালাকেও। তাঁর এক বাল্যবন্ধুর দাদা প্রবোধ মিত্র কাজের জন্য যাচ্ছিলেন পেশোয়ার। অনেক অনুরোধে তাঁকে রাজি করিয়ে তাঁর সঙ্গেই পালিয়ে যান ননীবালা দেবী। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। খোঁজ করতে করতে তাঁকে ধরে আনল ব্রিটিশ পুলিশ। সেই সময়ে তিনি কলেরায় মুমূর্ষু। কিন্তু পুলিশ তাঁকে শাস্তি দিতে ব্যগ্র। কয়েকদিন পেশোয়ার হাজতে রাখার পর একটু সুস্থ অবস্থায় তাঁকে নিয়ে আসা হয় কাশীর জেলে। আর সেখানেই শুরু হল অকথ্য অত্যাচার। জেলের সুপার বাঙালি ব্রাহ্মণ, অথচ স্বজাতির একটি মেয়েকে অশ্রাব্য অপমান করতে তার বাধত না। কিন্তু তাতেও কোনও তথ্য জানা যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত একদিন দুই জমাদারনি ননীবালাকে জোর করে ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। খুলে নেয় কাপড়চোপড়। তারপর শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হতে থাকে লঙ্কাবাটা। অত্যাচার এখানেই শেষ নয়। কবরের মতো এক আলোবাতাসহীন কুঠুরিতে আটকে রাখা হত তাঁকে। কিন্তু ননীবালা দেবী নাছোড়। বিপ্লবীদের সম্পর্কে একটি কথাও তাঁর মুখ থেকে বের করা গেল না।
হাল ছেড়ে দিয়ে পুলিস ননীবালা দেবীকে কাশী থেকে নিয়ে এল কলকাতা প্রেসিডেন্সি জেলে। ১৮১৮ সালের তিন নম্বর রেগুলেশনের ধারা প্রয়োগ হল তাঁর বিরুদ্ধে, প্রথম মহিলা রাজবন্দি হিসাবে প্রেসিডেন্সি জেলে এলেন তিনি। সেখানে গিয়ে তিনি খাওয়া বন্ধ করে দিলেন। জেল-কর্তৃপক্ষ, এমনকি জেলা-ম্যাজিস্ট্রেটও তাঁকে অনুরোধ করে খাওয়াতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত জানিয়েছিলেন বাগবাজারে সারদা মা’য়ের কাছে রেখে দিলে তিনি খাবেন। কিন্তু তাঁকে আবেদনপত্র লিখতে বলার পরেও তা ছিঁড়ে ফেলে দেন জেল সুপার। বাঘিনির মতো গর্জে উঠে ননীবালা দেবী এক চড় বসিয়ে দেন সাহেব সুপারের মুখে।
দুবছর এইভাবে বন্দীজীবন কাটানোর পর মুক্তি পান ননীবালা দেবী। কিন্তু পৈতৃক বাড়িতে ঠাঁই হল না। বিধবা হয়েও পরস্ত্রী সাজা, পরপুরুষের সাথে এক ঘরে থাকা বা পেশোয়ার যাওয়া- তাঁর বিরুদ্ধে যে অপরাধের লম্বা তালিকা। নিঃসহায় অবস্থায় একাই বাকি জীবনটা কাটাতে হয় ননীবালা দেবীকে। দেশের জন্যই যিনি বিলিয়ে দিয়েছিলেন নিজের জীবন।