টেনিস কোর্টেও যে ছবি আঁকা যায়, তা শিখিয়েছিলেন রজার ফেডেরার। শুধু খেতাব জয়ের নিরিখে নয়, বিশ্বজোড়া অনুরাগীদের মনেও তিনিই রাজা। তাঁর বিদায়ের দিনে তাই চোখ শুকনো থাকে না প্রবল প্রতিপক্ষেরও। সেই চোখের জলেই গল্পেই পাতা হয় রাজার আসন। হৃদয়ের অলিন্দে আজীবনের জন্য থেকে যান তিনি, বিস্ময় জাগানো সেই সুইস তরুণ। লিখলেন সৌরাংশু।
পুরনো কাগজের যে বাক্সটা পড়ে আছে কুলুঙ্গির উপরে, সেটা বার করে কাগজগুলো খুলে খুলে দেখি, কয়েকটা না-হওয়া কবিতা, খানকতক প্রেমপত্র, কিছু ফর্দের হিসেব, কয়েকটা অলস অকেজো আঁকিবুকি। যে মেয়েটিকে প্রথম প্রেমপত্র লিখেছিলাম, সে তার উত্তরে হৃদয় উপুড় করে দিল। হৃদয়, একটাই তো হৃদয়। কার জন্যই বা তোলা রাখি!
আরও শুনুন: জোকারের নির্লিপ্তি ভেঙে অশ্রু ঝরালেন আলকারাজ, উইম্বলডনে অভিষেক নতুন নায়কের
আমাদের শৈশবে রজার ফেডেরার ছিলেন না। আমাদের ছেলেবেলা জেভিয়ার পায়াস, গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, দিলীপ দোশি, শিবাজী ব্যানার্জি, জিকো, জনি ম্যাক, মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা, মহম্মদ শাহিদ, প্রকাশ পাড়ুকোনের। আমাদের কৈশোর তারুণ্য বিলিয়ে দিয়েছি বরিস বেকার, আজহার, সুদীপ চ্যাটার্জি, রুড হুলিট, রোমারিও, রোনাল্ডো নাজারিও, ওয়াল্ডনার, নিক ফাল্ডো, আয়ারটন সেনা, মাইকেল জর্ডন, শাহবাজ আহমেদ, ওয়াসিম আক্রমদের।
হিসেব করে দেখলাম, কারও চলে যাওয়ার পরে এমনভাবে ফাঁক তৈরি হয়নি। হয় তিনি ধীরে ধীরে দিনান্তে মিশে গেছেন, অথবা তলিয়ে গেছেন অন্ধকারে। আজহার, আয়ারটন সেনা, চোখ ভিজিয়ে বুক ছাপিয়ে বয়ে গিয়েছিল এঁদের চলে যাওয়া। ধোনির চলে যাওয়াটা তো সময়ের অপেক্ষা ছিল।
কিন্তু রজার? রজার ফেডেরার? রবি ঠাকুরের সেই গানটা- আজই গোধূলি লগনে…
সূর্য ডুবে গেছে কিছুক্ষণ, তবু তার রং রয়ে গেছে বিস্তীর্ণ ভুবনে। নারঙ্গি, বেগুনি অপার্থিব, লালচে হলুদ অথবা ঘন নীল ছাপিয়ে অমোঘ ধূসর। উদিত সূর্যের ডুবে যাওয়াটা ভবিতব্য, শুরুর শেষের মতোই। তবু তো হৃদয় অগোছালো হয়, দীর্ঘশ্বাসে ফিরে ফিরে আসে সূর্যোদয়ের ছটা। সামান্য ছোট্ট পনিটেলে সাদা হেডব্যান্ড নিয়ে ছেলেটা সম্রাটের সাম্রাজ্যে হানা দিয়ে টেনিসের যান্ত্রিক আধুনিকীকরণের মাঝে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বছর কুড়ি। গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিততে জিততে অবশ্য আরও দু’বছর, ২০০৩। তারপর আর থামানো যায়নি।
রাফার ছিল লাল সুরকি, নোভাকের রিটার্ন। রজারের ছিল তুলি। যে তুলিতে পেশির ওজন চাপিয়ে আজকাল গোলা ছোড়া হয়, রজার তাই দিয়েই ছবি আঁকতেন। তা বলে কি দরকারে গোলাগুলি ছোড়েননি? ২০০৯-এ উইম্বলডনে, রডিক ছুড়লেন বাথটাব, রজার ছুড়লেন সুইমিং পুল। তারপরের বছর আস্ত একটা মহাকাশযান ছুড়ে দিয়েও থামাতে পারেননি রাফার রকেট। বহু পরে ২০১৫-য় সব শেষ হয়ে যাবার পর ফিরে এসে ডিপ ব্যাকহ্যান্ড টপস্পিনের শব্দভেদী বাণ ছুড়ে থামিয়ে দিলেন রাফার হৃদয়তন্ত্র, মেলবোর্নের ফ্লিন্ডার্স পার্কের নীল কোর্টে, ২০১৭-তে।
নিবে যাবার আগে যেমন রংমশাল তার হৃদয় খুঁড়ে সেরা রামধনুটা উপহার দিয়ে যায়, রজারও তেমনই ২০১৯-এর উইম্বলডন ফাইনালে দিলেন।
“সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে- সব নদী- ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”
এখন অবসর, সময় হয়েছে মুখোমুখি বসিবার, নিশ্ছিদ্র অন্ধকার জুড়ে। টেনিসের রক্তমাখা সংগ্রামের যে দু-দণ্ড শান্তি আমরা দু-দশক জুড়ে পেয়েছিলাম, তা চিরনিঃশেষ হয়ে গেছে গত বছর।
আরও শুনুন: আবেগের ধারাপাত নয়, ধারালো ব্যক্তিত্বেই সত্যিকার অধিনায়ক সুনীল
কত কিছুই করা হয়নি। রাফা, নোভাক দুজনেই ডিঙিয়ে চলে গেছে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ে। সর্বকালের সেরা হবার দৌড়েও। এখনও মনে মনে ভাবি, হয়তো একটা ফিরে আসা লেখা ছিল, জর্জরিত শরীর তা আর হতে দেয়নি। যেমন থেকে যায় আর কি! কত কিছু চাইবার থেকে গেল। হয়তো মনের জোর দিতে পারত অনেক কিছুই, ২০১২ থেকে ২০১৭-র দীর্ঘস্থায়ী মরুভূমিতে সামান্য বৃষ্টিপাত। হয়তো গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আনফোর্সড এরর করে নোভাককে যুক্তরাষ্ট্র ওপেন বা ২০১৯ উইম্বলডন অথবা রাফাকে ফ্রেঞ্চ দিয়ে আসতে হত না। কিন্তু তাই তো মনে হয়, ঐশ্বরিক ধনুর্বিদ অর্জুনও মানুষ। আমাদের ভিতর থেকেই ছিটকে আসা জ্যোতিষ্ক, কিন্তু মানুষই। হাতে গাণ্ডিব নিয়েও কুরুক্ষেত্রে, হাঁটু মুড়ে বসে প্রিয়জনকে তির ছোড়ার দ্বন্দ্বের মধ্যেই রজারের সম্পূর্ণতা ছিল।
রজার চলে গেছেন এক বছর হতে চলল, তবু অমলিন হয়নি ইতিহাসের অক্ষরকণাগুলি। মুক্তোর মতো ছড়িয়ে রয়েছে অপার্থিব অস্তিত্ব নিয়ে।
কাগজগুলোকে ঝেড়ে বেছে আবার নতুন করে গুছিয়ে নিয়েছি। হয় না, হৃদয়ের এত কাছাকাছি আর কেউ আসে না হয়তো। এই তো উইম্বলডন ফাইনালে নতুন রাজা আলকারাজের মাথায় মুকুট উঠল যন্ত্রাধীশ নোভাককে ডিঙিয়ে। দেখলাম। হয়তো চোখের কোণটা টেনিস কোর্ট দেখলে আজও ঝাপসা হয়ে আসে। চুলে পাক ধরেছে, অস্থানে মেদ। অসময়ে ক্লান্তি নেমে আসে চোখে। তবু বন্ধ চোখে মনের ভিডিও পর্দায় বেছে বেছে মুহূর্তগুলিকে উলটে পালটে দেখি, নিজের সঙ্গে কিছুক্ষণ। দ্বিতীয় সার্ভিসে হঠাৎ সার্ভিস লাইনে উঠে এসে ড্রপ শট, র্যালি চলাকালীন বীণার টানে নেট ছুঁইয়ে বলটাকে বশে রাখা, মসলিনি ভলি, মাখনচেরা ব্যাকহ্যান্ড, চাবুক ফোরহ্যান্ড অথবা সেই সার্ভিসের আগের মুহূর্তে অতিরিক্ত বল ধরা বাঁ হাতের মধ্যমা দিয়ে কপালের উপরের একগাছি চুল সরিয়ে দেওয়া। আলোকবর্তিকা, এভাবেই মনের পর্দায় থেকে গেছেন তিনি।
টেনিস তার ভবিতব্য মেনেই দানবদের হাতে চলে গেছে, যেতই। তবু দু-দণ্ড দু-দশক মানবপ্রভা ছড়িয়ে ঘাসের কাছাকাছি রেখেছিলেন তিনি। কুড়ি কুড়ি বছর পার হয়ে প্রাজ্ঞতার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ফিরে দেখা সময়কে ধন্যবাদ। হাতের মুঠোয় বালির গল্পে এক রজার ফেডেরার ছিল আমাদের। যৌবনে, উত্তর যৌবনে। রজার ফেডেরার, হৃদয়ের অলিন্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিয়ে গেছেন তিনি, বাসেলের বনলতা সেন।