গভীর সমুদ্রে আপনা থেকেই ভেসে বেড়াচ্ছিল জাহাজ। অথচ সেই জাহাজে ছিলেন না কোনও ক্যাপ্টেন কিংবা নাবিক। একটি জনপ্রাণীরও দেখা মেলেনি গোটা জাহাজে। কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা? আর চালক ছাড়া কীভাবেই বা চলছিল সেই জাহাজ? এক আশ্চর্য রহস্যে মোড়া এই জাহাজের কাহিনি, যাকে কেউ বলে অভিশপ্ত, কেউ বা বলে ভূতুড়ে। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
চারিদিকে অতলান্ত জলরাশি। এ কূল ও কূল দেখা যায় না। তার মধ্যেই ভেসে চলেছে জাহাজটি। বায়নোকুলার দিয়ে তাকে দেখে একটু অবাকই হলেন ক্যাপ্টেন ম্যুরহাউজ। দেই গ্রেশিয়া জাহাজের ক্যাপ্টেন তিনি। পাড়ি দিচ্ছেন জিব্রাল্টারের উদ্দেশে। অন্য জাহাজটিও তাঁর ভালোমতোই চেনা, কিন্তু তার তো এখন এদিকে আসার কথাই নয়। মেরি সিলেস্টা নামের ওই জাহাজের ক্যাপ্টেন তাঁরই বন্ধু বেঞ্জামিন ব্রিগস। সফর শুরুর আগেই দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে। জাহাজিদের আড্ডায় মদ নিয়ে বসে গল্পগুজবও হয়েছিল দিব্যি। আর সেখানেই বেঞ্জামিন জানিয়েছিল, এবার সফরে নিজের স্ত্রী আর মেয়েকেও নিয়ে যাচ্ছে সে। বেশ লম্বা পাড়ি। এক জাহাজ মদ নিয়ে জেনেভা যেতে হবে। এতদিন ছোট্ট মেয়েটাকে ছেড়ে থাকতে ভাল লাগে না, বলছিল বেঞ্জামিন। কিন্তু সে হঠাৎ এই মাঝসমুদ্রে কী করছে? জেনেভা যাওয়ার পথ তো এটা নয়!
কেমন যেন মনটা কু ডাকছিল ক্যাপ্টেন ম্যুরহাউজের। কোনও বিপদে পড়ল নাকি জাহাজটা? সমুদ্রে জলদস্যুদের উৎপাত লেগেই থাকে। তা ছাড়া যন্ত্রপাতি খারাপ হয়ে দিকভুল হওয়াও অসম্ভব নয়। মেরি সিলেস্টার উদ্দেশে সংকেত পাঠালেন ক্যাপ্টেন। একবার। দুবার। কিন্তু কোনও ফিরতি সংকেত এল না। কপালের ভাঁজ আরও গাঢ় হল ক্যাপ্টেনের। দুজন নাবিককে ডেকে পাঠালেন তিনি। ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা দরকার।
– স্যার!
– এসে গিয়েছ তোমরা? শোনো, একটা বোট নামাও এক্ষুনি। ওই যে দ্যাখো, জাহাজটা দেখতে পাচ্ছ? কয়েকবার মেসেজ পাঠালাম, কেউ সাড়া দিচ্ছে না। ব্যাপারটা সুবিধের ঠেকছে না ঠিক। যাও তো, একটু দেখে এসো ব্যাপারটা।
আরও শুনুন: নাচের ছন্দে খসে পড়ত পোশাক, গুপ্তচর মাতা হারির শরীরী আগুনে পতঙ্গের মতো ঝাঁপ দিত শত্রুরা
দুজন নাবিককে রওনা করিয়ে দিয়ে ফের বায়নোকুলারটা চোখে তুলে নিলেন ক্যাপ্টেন। ঢেউয়ের দোলায় মেরি সিলেস্টা এখন আরও কাছাকাছি। জাহাজের আলোগুলো জ্বলছে। ডেক থেকে আকাশের দিকে মাথা উঁচিয়ে রয়েছে মাস্তুলগুলো। কিন্তু ডেকে একটি প্রাণীরও নড়াচড়া চোখে পড়ছে না। এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল ক্যাপ্টেনের। সেই কবে থেকে জাহাজ চালাচ্ছেন তিনি। জলই তাঁর জীবন। কে জানে, মৃত্যুও হয়তো লেখা আছে এই জলেই। যেমনটা ছিল তাঁর অনেক আত্মীয় বন্ধুরই। সেসব নিয়ে ভাবেন না ক্যাপ্টেন ম্যুরহাউজ। তবে এতদিন জলেই থাকতে থাকতে জলের গল্প জানেন তিনি। জানেন, জল কখনও কখনও কাউকে বুকে টেনে নেয়। জানেন, এই অতলান্ত জলেই ভেসে বেড়ায় এমন সব গল্প, যা শুনলে পরে বুক কেঁপে ওঠে। এই তো, মেরি সিলেস্টার কথাই ধরা যাক না! এই জাহাজ ঘিরেও কম গল্প আছে নাকি! জাহাজটা তৈরির সময় থেকেই তো অঘটন ঘটতে বাকি থাকেনি। ক্যাপ্টেনের মনে আছে, বছর দশেক আগে এই জাহাজটা বানানো হয়েছিল। সেটা ১৮৬১ সাল। তখন নাম দেওয়া হয়েছিল আমাজন। ১০০ ফুট লম্বা, ২৫ ফুট চওড়া জাহাজ। ভালই জিনিসপত্র ধরবে। কিন্তু কোথায় কী! সফরের মধ্যেই কী এক মারণ অসুখে ধরল জাহাজের ক্যাপ্টেনকে। মারাও গেলেন ওই রোগেই। এদিকে তখনও সফর শেষ হয়নি। জলের মধ্যে একটা মৃতদেহ নিয়ে কী করবে, কীভাবে রাখবে, নাবিকদের যাকে বলে পাগল হওয়ার জোগাড়। সেই নাবিকদের মুখ থেকেই পরে এসব গল্প শুনেছেন ক্যাপ্টেন ম্যুরহাউজ। বিপদ অবশ্য এখানেই শেষ হয়নি। ফেরার পথে মাছ ধরার জাহাজ না কীসের সঙ্গে যেন জোর ধাক্কা লাগে জাহাজের। ডুবে না যাক, জাহাজের কম ক্ষতি হয়নি তাতে। সারানোর জন্য জাহাজটাকে শিপইয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু জাহাজটা ঢুকতেই ওই শিপইয়ার্ডে নাকি আচমকা আগুন ধরে যায়। অথচ আমাজন জাহাজে আগুনের আঁচ পর্যন্ত লাগেনি। তা এরকম কাণ্ড দেখে কেউ ভয় পাবে না? সেই থেকেই জাহাজটার কেমন যেন বদনাম হয়ে গেল। বেঞ্জামিন যখন জাহাজটা কিনল, তখনও ম্যুরহাউজ একটু খুঁতখুঁত করেছিলেন। এখনও অব্দি যারাই এই জাহাজ কিনেছে, কারোরই লোকসান বই লাভ হয়নি। একবার তো ঝড়ের পাল্লায় পড়ে ভেঙেচুরে একশা কাণ্ড! মালিক আর সারানোর ঝঞ্ঝাটে যায়নি, কিন্তু কেপ ব্রেটন দ্বীপে ফেলে রেখে দিয়েছিল। তারপর নাহয় আলেকজান্ডার ম্যাকবিন সেটা তুলে এনে প্রায় নতুন করেই বানিয়েছেন। মেরি সিলেস্টা নামটাও তাঁরই দেওয়া। তবে তাঁর হাতেও জাহাজ বেশিদিন থাকেনি। এক মালিক যেন ওর পোষায় না। ঠিক বন্দরের মেয়েগুলোর মতোই। সে যাই হোক, ওই মেয়েদের সঙ্গে তো আর কেউ ঘর করতে যায় না। কিন্তু জাহাজ তো নাবিকের কাছে ঘরের চেয়েও বেশি। তা কে কার কথা শোনে! বেঞ্জামিন কি আর সেসব কথা শোনার পাত্র! বরাবরের ডাকাবুকো ছেলে। সেই অভিশপ্ত জাহাজেই এবার প্রচুর পরিমাণে মদ নিয়ে নিউ ইয়র্ক বন্দর থেকে ইটালির জেনেভার উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছে সে।
আরও শুনুন: নেশা বিকৃত যৌনতার, খুন করে অন্তর্বাস জমিয়ে রাখার শখ সিরিয়াল কিলারের
এসব ভাবতে ভাবতেই জাহাজে ফিরে এল সেই দুজন নাবিক, যাদের বেঞ্জামিনের জাহাজে পাঠিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন। কিন্তু দুজনকে দেখে চমকে গেলেন ক্যাপ্টেন ম্যুরহাউজ নিজেই। এ কী চেহারা হয়েছে তাদের! ভয়ে থরথর করে কাঁপছে দুজনেই! মুখ ফ্যাকাশে, কথা বেরোচ্ছে না প্রায়। আস্তে আস্তে তাদের থেকে যা শোনা গেল, তা শুনে চমকে উঠলেন ক্যাপ্টেনও। জাহাজটা নাকি এমনি এমনিই জলে ভাসছে। কোনও চালক নেই তার। শুধু তাই নয়, গোটা মেরি সিলেস্টা জাহাজে নাকি একজন প্রাণীও নেই। অথচ সব জিনিসপত্র যেমন কে তেমন রয়েছে। খাবার পানীয় সব সাজানো। মনে হচ্ছে যেন কিছুক্ষণ আগেই কেউ খাচ্ছিল, কেউ হয়তো কাজ করছিল, যেন একটুক্ষণের জন্য উঠে গিয়েছে। কিন্তু গোটা জাহাজ তন্নতন্ন করে খুঁজেও বেঞ্জামিন, তার স্ত্রী, মেয়ে, এমনকি আরও যে সাতজন ক্রু ছিল, তাদের কারও চিহ্ন পর্যন্ত মেলেনি। আর খালি ছিল মদ ভর্তি করা ব্যারেলগুলো। তাহলে কি কেউ আক্রমণ করেছিল? নাকি কোনও দুর্ঘটনায় ওই ব্যারেলগুলো ফুটো হয়ে যায়? সেই দুর্ঘটনাই বা কী? যদি যাত্রীরা মারা গিয়েও থাকেন, তাহলে তাঁদের দেহই বা কোথায়? উত্তর মিলল না কোনও প্রশ্নেরই। আর খোঁজ মিলল না যাত্রীদেরও। না জীবিত, না মৃত, কোনও যাত্রীই আর ফিরে আসেননি। অভিশপ্ত জাহাজ তার অভিশাপের ধারা বজায় রেখেছিল। সমুদ্রের রহস্যের তালিকায় আরও একটি ঘটনা হয়েই তাই রয়ে গিয়েছে মেরি সিলেস্টা জাহাজের কাহিনি।