যত মত তত পথ- শ্রীরামকৃষ্ণের এই বাণী সর্বধর্ম সমন্বয়ের আকর কথা। এই বাণীর মধ্যে যে ধর্মীয় উদারতা, তা আমাদের আধ্যাত্মিক আকাশে জ্বেলে দেয় অন্যতর আলো। এই যে গভীর বাণী তা যেন রাখা ছিল শ্রীকৃষ্ণের কথাতেও। শ্রীগীতায় মেলে সেই ইঙ্গিত। আসুন শুনে নিই।
সাধন করলে ঈশ্বরের দর্শন মেলে। পৌঁছানো যায় ঈশ্বরের কাছে। এই সাধনের নানা পথ হতে পারে। নানা পথ নিয়ে অনেকসময়ই মতের পার্থক্য দেখা যায়। তবে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ যেন মাত্র একটা কথাতেই সেই পথের সমস্যার সমাধান করে দিলেন। পথের ভিন্নতাকে নিমেষে দূর করে দিয়ে তিনি বললেন, ‘যত মত তত পথ’। এ শুধু তাঁর কথার কথা নয়। তিনি নিজে বিভিন্ন সাধনপথে সিদ্ধিলাভ করেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। আর জগৎবাসীকে শুনিয়ে গিয়েছিলেন এই মহৎ উদার বাণী। খুব স্পষ্ট করেই তিনি বলেছিলেন, আমি বলি, সকলেই তাঁকে ডাকছে। দ্বেষাদ্বেষীর দরকার নাই। কেউ বলছে সাকার, কেউ বলছে নিরাকার। আমি বলি, যার সাকারে বিশ্বাস সে সাকারই চিন্তা করুক, যার নিরাকারে বিশ্বাস, সে নিরাকারই চিন্তা করুক। তবে এই বলা যে, মতুয়ার বুদ্ধি ভাল নয়;” অর্থাৎ ডগম্যাটিক মা গোঁড়া হতে মানা করছেন তিনি।
আরও শুনুন: সপ্তর্ষিমণ্ডলের ঋষি তিনি, নররূপে নারায়ণ হয়ে এসেছিলেন জীবের দুর্গতি নিবারণে
যেন বহুদিনের বহু দ্বন্দ্ব নিরসন করে দিয়েই তিনি বলেছিলেন, ‘যত মত তত পথ। যেমন এই কালীবাড়িতে আসতে হলে কেউ নৌকায়, কেউ গাড়িতে, কেউ বা হেঁটে আসে, সেইরূপ ভিন্ন মতের দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন লোকের সচ্চিদানন্দ লাভ হয়ে থাকে। নদী সব নানা দিক দিয়ে আসে, কিন্তু সব নদী সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। সেখানে সব এক। সব ধর্মই সত্য। যেমন কালীঘাটে নানা পথ দিয়ে যাওয়া যায়। সব ধর্মের লোকেরা একজনকেই ডাকছে।’
ঠিক এই কথাটিই তো বলেছিলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীগীতার জ্ঞানযোগে অর্জুনকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলছেন,
যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।
অর্থাৎ তিনি বলছেন, ‘হে পার্থ, যে আমাকে যে ভাবে উপাসনা করে, আমি তাহাকে সেই ভাবেই তুষ্ট করি। মনুষ্যগণ সর্বপ্রকারে আমার পথেরই অনুসরণ করে অর্থাৎ মনুষ্যগণ যে পথই অনুসরণ করুক না কেন, সকল পথেই আমাতে পৌঁছিতে পারে।’
আরও শুনুন: ‘আমাকে কি ত্যাগ করবেন?’ প্রশ্ন ধর্মত্যাগী মাইকেল মধুসূদনের, ঠাকুর বললেন…
অর্থাৎ সব পথ এসে শেষে শ্রীকৃষ্ণ বা ঈশ্বরেই মেশে। পথের ভিন্নতা কিন্তু স্বয়ং কৃষ্ণও অস্বীকার করেননি। আমরা বুঝতে পারি, সেদিন অর্জুনকে ঈশ্বর যা বলেছিলেন, তাই-ই আমরা পরবর্তীকালে পেলাম ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মুখে। যুগের প্রয়োজনে তিনি আমাদের শিখিয়ে দিলেন আগামীতে চলার মন্ত্র। শিখিয়ে দিলেন, কারও পথ নিয়ে দ্বেষ পুষে রাখার দরকার নেই। কেননা ‘সব মতই পথ, মত কিছু ঈশ্বর নয়’। আর তাই অন্যের মত ভুল, এ ভাবার দরকার নেই। যদি ভুল হয়েই থাকে, তবে যিনি শুধরে দেবার তিনিই তা শুধরে দেবেন। এই উদার সহিষ্ণুতাই যে জগতের চালিকাশক্তি। যুগে যুগে সেই কথাটিই আমাদের শিখিয়ে দেন মহাপুরুষগণ।