এক হিন্দু পুরোহিতের আশীর্বাদে সেরে যাচ্ছে একজন মুসলমান নবাবের অসুখ। আর তাই নবাব ইচ্ছা প্রকাশ করলেন মন্দির নির্মাণের। তৈরিও হয়েছিল সেই মন্দির। আবার, একদল কট্টর মুসলমান দখল নিতে চাইছে মন্দিরের। তখন আর-এক নবাব নিজের সেনাবাহিনী দিয়েই রক্ষা করলেন মন্দিরটিকে। সাম্প্রতিক মন্দির-মসজিদ রাজনীতির নিরিখে এই সব ঘটনা যেন আমাদের কাছে অচেনা ঠেকে। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। বরং ইতিহাস জানায়, এমনটা সত্যিই ঘটেছিল। আসুন শুনে নেওয়া যাক।
ঘোরতর অসুস্থ আউধের নবাব সুজা-উদ-দৌলা। বিস্তর চিকিৎসা সত্ত্বেও অসুখ যেন কিছুতেই সারতে আর চায় না। সেই সময় নবাবের এক পারিষদ তাঁকে একটি পরামর্শ দিলেন। জানালেন, হিন্দু তপস্বী বাবা অভয় রাম দাসের আশীর্বাদ যদি নবাব নেন, তাহলে তিনি সেরে উঠতে পারেন। ব্যক্তিগত ধর্মাচরণ সেদিন কারোর পথেই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। নবাব সানন্দে তপস্বীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করলেন। সাধুও ধর্মের ঊর্ধ্বে মানবিকতাকেই স্থান দিলেন। এক দিন, দু’দিন নয়, টানা আট দিন নবাবের কাছে গিয়েছিলেন সাধু। তাঁর আশীর্বাদ, প্রার্থনায় ক্রমে সুস্থ হয়ে ওঠেন সুজা-উদ-দৌলা। নবাব ঠিক করেন, তিনি একটি মন্দির তৈরি করবেন।
আরও শুনুন: ৫ বছরে আত্মহত্যা ৯৮ পড়ুয়ার! উদ্বেগ বাড়াচ্ছে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পরিস্থিতি
সে মন্দির কি তৈরি হয়েছিল? ইতিহাস বলে, নিশ্চিতই হয়েছিল। হনুমানগড়ি মন্দির বলে যা বিখ্যাত, তার নির্মাণের নেপথ্য কাহিনি এটাই। মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হিসাবে মোহন্ত জ্ঞান দাস বারংবার এই ইতিহাসের উপর জোর দিয়েছেন। জানিয়েছেন, এই মন্দিরের জন্য জমি দান করেছিলেন নবাব স্বয়ং। ১৭৭৪ সালে ৫২ বিঘা জমির উপর মন্দির গড়ে ওঠে, যা নবাবেরই দান। পবর্তীকালে এ নিয়ে যাতে কোনও ঝামেলা না বাধে, সে কারণে রীতিমতো তাম্রপত্রে এই দানের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে নবাবের পুত্র মনসুর আলিও বিভিন্ন সময় মন্দিরে এসেছেন এবং প্রচুর দানধ্যান করেছেন।
আরও শুনুন: নতুন যুগের রানার তাঁরা, শ্রমিকের সুবিধা কি আদৌ পাবেন?
এ অবশ্য শুধু মন্দিরের পুরোহিতের মুখের কথা নয়। পারসি ভাষায় লেখা এই নথিটির হদিশ সত্যিই মেলে। যা থেকে বোঝা যায়, এই হিন্দুরমন্দির তৈরির নেপথ্যে নবাবের ভূমিকা ছিল। ইতিহাসবিদরা জানিয়েছেন, মন্দিরে পারসি ভাষায় লেখা একটি ফলকও দেখা যায়। যেখানে নবাবের এই দানের উল্লেখ আছে। আউধের নবাবরা বরাবর সমন্বয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁদের আমলে বহু হিন্দু কর্মীরাই প্রশাসনের গুরুদায়িত্ব সামলেছেন। তা নিয়ে কখনই ধর্মীয় কোনও বিরোধ দেখা যায়নি। বরং বিরোধের পরিস্থিতি যখন দেখা দিয়েছে, তখন তা কঠোর হাতেই নিয়ন্ত্রণ করেছেন নবাবরা। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথাও জানান ইতিহাসবিদরা। তখন চলছে নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের রাজত্বকাল। একদল মুসলিম কট্টরপন্থীরা সেই সময় হনুমান মন্দির ও সীতা রসুইয়ের দখল নেওয়ার চেষ্টা করে। কড়া হাতে সেই বিদ্রোহ দমন করেছিলেন নবাব। সে কাজ খুব সহজ ছিল না। এক মুসলমান মৌলবির নির্দেশে তখন প্রায় খেপে উঠেছিল এই কট্টরপন্থী দল। মন্দির রক্ষা করতে সেনাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ্। বিদ্রোহ দমন করে মন্দিরের গায়ে হাত দিতে দেননি সেদিন নবাবের সেনারাই। তবে সেই কাজ করতে গিয়ে বহু সেনা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী। অর্থাৎ নবাবের নির্দেশে মুসলিমরা সেদিন নিজেদের প্রাণ দিয়েই মন্দির রক্ষা করেছিলেন।
ইতিহাসের এই বিবরণী যে একেবারে লুপ্ত, তা নয়। বরং তা সযত্নেই রক্ষিত আছে। কিন্তু মন্দির-মসজিদ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের উত্তাল রাজনীতি সেগুলোর দিকে যেন তাকানোরই অবসর দেয় না।