নাচতে নাচতে দেহ থেকে খসে পড়ছে একের পর এক পোশাকের টুকরো। আর সেই ভরা শরীরের প্রতিটি বাঁক দুচোখ দিয়ে গ্রাস করে নিচ্ছে পুরুষেরা। এমনই এক অমোঘ নেশার নাম ছিলেন মাতা হারি। যৌনতাকে হাতিয়ার করেই নাকি দিনের পর দিন তিনি চালিয়ে গিয়েছিলেন গুপ্তচরবৃত্তি। শোনা যাক তাঁর গল্প।
মনের মতো পাত্রী চাই। সুন্দরী, রুচিশীল, অল্পবয়সি কোনও তরুণী। কাগজের পাতা ওলটাতে ওলটাতে বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়েছিল মার্গারিটার। বিজ্ঞাপন দিয়েছেন পাত্র নিজেই। তিনি নাকি ইন্ডিজের সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন, আপাতত নেদারল্যান্ডে আছেন ছুটিতে। সাতপাঁচ না ভেবেই বিজ্ঞাপনের একটা লাগসই জবাব লিখে ফেলল মার্গারিটা। লেখার আর বেশি কী আছে? তার বয়স বছর বাইশ, উচ্চতা পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি। আর যৌন আবেদন? তাকে দেখলে যে কোনও পুরুষের বুকের রক্ত চলকে ওঠে। স্কুলে পড়ার সময় খোদ প্রধান শিক্ষক অব্দি তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। পুরুষের মুগ্ধ দৃষ্টি পেতে সে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে অনেকদিনই। কিন্তু শুধু সেটুকু দিয়ে তো আর দিন চলে না।
ধনী বাবার আদরে বড় হওয়া মেয়ে, ছোটবেলা থেকেই বিলাসে অভ্যস্ত। কিন্তু হঠাৎ বাবার ব্যবসায় ভরাডুবি, তারপর মায়ের মৃত্যু, সব মিলিয়ে একটা নিরাপত্তাহীন বিপর্যস্ত জীবনে এসে দাঁড়িয়েছে সে। এই অবস্থায় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেনের সঙ্গে বিয়ে মানে অর্থ সুখ স্বাচ্ছন্দ্য সবই মিলবে ফের, তা হোক না সেই পুরুষ বয়সে তার প্রায় দ্বিগুণ।
আরও শুনুন: Sex Slave: যৌনদাসীর দিনরাত, ভয়াবহ অভিজ্ঞতা জানিয়েছিলেন Nadia Murad
ক্যাপ্টেন রুডল্ফ ম্যাকলিওডের সঙ্গে বিয়েটা তাই হয়েই গেল মার্গারিটার। যার পুরো নাম মার্গারিটা গের্ট্রুডা জেল। ১৮৭৬-এর ৭ অগস্ট নেদারল্যান্ডসেই জন্ম তার। বিয়ের পর অবশ্য সেই চেনা দেশ ছেড়ে তাকে পাড়ি দিতে হল ইন্দোনেশিয়ায়। পরপর দুই সন্তানের জন্ম। দুর্ভাগ্য অবশ্য পিছু ছাড়ল না। স্বামীর অত্যাচারে প্রাণ ওষ্ঠাগত মার্গারিটার। তার উপরে লোকটি চূড়ান্ত মদ্যপ। যৌনরোগে আক্রান্তও বটে। বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সেই সিফিলিস পেয়েছিল দুই সন্তানই। মেয়েকে কোনও ক্রমে বাঁচানো গেলেও, ছেলেটি মারা গেল। অসুখী দাম্পত্যের জেরে এমনিতেই একের পর এক সামরিক অফিসারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছিলেন মার্গারিটা। অবশেষে সম্পর্কের শেষ সুতোটাও ছিঁড়ে গেল। মেয়েকে নিজের কাছে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু… টাকা নেই যে।
কপর্দকশূন্য হয়ে প্যারিসে পা রাখলেন মার্গারিটা। সেটা ১৯০৩ সাল। নিজের নাম নিলেন মাতা হারি, ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় ভাষায় যার অর্থ ‘ভোরের আলো’। বললেন তিনি নাকি জাভার রাজকুমারী। সেই পরিচয়েই কিছুদিন সার্কাসে কাজ, তারপর ঢুকে পড়লেন নাচের দুনিয়ায়। শরীরী ছলাকলা বরাবরই তাঁর আয়ত্তে। ইন্দোনেশিয়ায় থাকার সময় সেখানকার নৃত্যশৈলী শিখেছিলেন, এবার সুযোগ বুঝে তা কাজে লাগালেন। লোকে বলে, স্ট্রিপটিজের শুরুয়াত হয়েছিল তাঁর হাতেই। মাতা হারি নাকি পাতলা ওড়না শরীরে জড়িয়ে মঞ্চে আসতেন, নাচতে নাচতে ছুড়ে দিতেন সেটাও। তাঁর হাস্যে লাস্যে মাতাল হয়ে উঠল গোটা প্যারিস। অর্থের অভাব রইল না আর। পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল বিলাসব্যসন, আড়ম্বরের খরচ। আর বাড়তে লাগল পুরুষ সঙ্গীর তালিকা। ১৯১০ সালের মধ্যে সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর নাম। নাম, নাকি বদনাম? তা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না এই রমণীর। রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্সের উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার, ধনী আর অভিজাত পুরুষ, কার শয্যাসঙ্গিনী হননি তিনি!
দুহাতে টাকা ওড়াচ্ছিলেন মাতা হারি। কিন্তু সমস্ত হিসেবনিকেশ ওলটপালট করে দিল ১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। নেদারল্যান্ডস সে যুদ্ধে নিরপেক্ষ, তাই স্বাধীন ডাচ নাগরিক হিসাবে ইউরোপে ঘোরাফেরা করতে বাধা ছিল না মাতা হারির। আর সেটাই হল কাল। জার্মানিতে গিয়ে আটক হলেন মাতা হারি, বাজেয়াপ্ত হল টাকাপয়সা গয়না সব। সেই সময়েই কার্ল ক্রোমার নামে এক জার্মান কনসালের কাছ থেকে উড়ে এল সুবর্ণ সুযোগ। মুক্তি তো মিলবেই, সঙ্গে মিলবে ২০ হাজার ফ্রাঁ। শর্ত একটাই। জার্মানির হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতে হবে। টাকা আর শরীর, কোনোটা নিয়েই শুচিবাই ছিল না মাতা হারির। সুতরাং টাকা নিয়ে ফিরে এলেন প্যারিসে। সঙ্গে কোড নেম, H-21।
মাতা হারি জানতেনও না, সেদিন থেকেই পুলিশের নজরবন্দি হয়ে গিয়েছেন তিনি। আসলে সতর্কতা, হিসেব করে পা ফেলা, এসব তাঁর ধাতেই ছিল না কোনও দিন। তিনি যা চেয়েছেন, তা পাওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বরাবর। জার্মানিতে গিয়ে যেমনটা করেছিলেন, কিছুদিন পরেই তেমনটা তিনি করলেন ফ্রান্সেও। প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করার জন্য তিনি তখন মরিয়া। হ্যাঁ, নিছক পুরুষ সঙ্গী নয় আর, প্রেমিক। মাতা হারির বয়স ততদিনে চল্লিশ ছুঁয়েছে। যৌন আবেদন কমেনি, কমেনি নাম যশ, কিন্তু একের পর এক পুরুষের হাতবদল হওয়ারও তো ক্লান্তি থাকে। তা সে যতই নিজের ইচ্ছায় হোক না কেন। আসলে তো সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে ভরা একটা ঘরের স্বপ্নও দেখেছিলেন তরুণীবেলার মার্গারিটা। সেই স্বপ্নটাই হয়তো এতদিন পর ফের ফিরে এসেছিল। এক রাশিয়ান পাইলট ভাদিম মাসলভ-এর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন মাতা হারি। যুদ্ধের সময় দুজনের দেখাশোনা হওয়া কি মুখের কথা! কিন্তু মাতা হারি নিশ্চিন্ত। নিজের রূপযৌবনের উপর তাঁর অগাধ আস্থা। তা ছাড়া এতদিনের প্রসাদভোগী পুরুষেরা তো আছেই। প্রয়োজনে তাদের কাজে লাগাতে বাধা কোথায়! কিন্তু সেই কাজে লাগানোর মতলবটা যে তাঁর দেশই করছে, তা তিনি বুঝতেও পারেননি। যুদ্ধক্ষেত্রে গুরুতর আহত হয়েছিলেন মাসলভ, তাঁর কাছে পৌঁছনোর জন্য ফ্রান্সের গোয়েন্দা বিভাগের এক আধিকারিকের শরণাপন্ন হলেন মাতা হারি। আর, এখানেও সেই জার্মানির পুনরাবৃত্তি ঘটল। আসলে, মাতা হারির অমোঘ নেশার কথা তখন জানত গোটা ইউরোপ। যুদ্ধের সময় সেই নেশাটাকে ব্যবহার করেই বিপক্ষের গোপন খবর জানতে চাইছিল একেকটা দেশ। তাই জার্মানির মতো, ফ্রান্সেও প্রস্তাব এল, প্রেমিকের কাছে যাওয়ার অনুমতি মিলবে, তবে ফ্রান্সের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির শর্তে। মাতা হারি রাজি হয়ে গেলেন। কারণ আহত মাসলভের পক্ষে আর সেনাবাহিনীতে ফেরা সম্ভব ছিল না, এদিকে দুজনে ঘর বাঁধতে গেলে অনেক টাকার দরকার। নিজের জন্য ১০ লক্ষ ফ্রাঁ দাম হাঁকলেন মাতা হারি।
আরও শুনুন: নগ্নতাই যখন পেশা, কেমন কাটে ন্যুড মডেলদের দিন?
গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতে গিয়েই স্পেনে আটক হলেন মাতা হারি। কিন্তু ফ্রান্স থেকে কোনও সহায়তা এল না। অগত্যা, গতি সেই রূপ আর যৌবন। এক জার্মান গোয়েন্দাকর্তাকে যৌনতার টোপ দিয়ে ভোলালেন মাতা হারি। তাঁর থেকে জার্মান রণকৌশল সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নিয়ে পাঠালেন ফ্রান্সে, ভাবলেন এবার হয়তো কথামতো পারিশ্রমিক মিলবে। এদিকে জার্মান অফিসারকেও ফ্রান্স সম্পর্কে ছোটখাটো তথ্য জানাতে হয়েছিল। সেই অফিসার বার্লিনে ওই খবরগুলি পাঠালেন যে কোডে, তার অর্থ ফ্রান্সের জানা। মাতা হারিকে ফ্রান্সের কাছে জার্মান গুপ্তচর বলেই ফাঁসিয়ে দিতে চাইছিলেন তিনি, আর ঘটল তেমনটাই। ফ্রান্স ধরে নিল, মাতা হারি আসলে ডাবল এজেন্ট। তিনি একইসঙ্গে ফ্রান্স ও জার্মানি দুপক্ষের হয়েই কাজ করছেন।
১৯১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্যারিসের এক হোটেল থেকে মাতা হারিকে গ্রেফতার করা হল। তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন কুখ্যাত সঁ লাজার জেলে। দিনের পর দিন জেরা চলল। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য নানা জায়গায় অজস্র চিঠি লিখলেন মাতা হারি। কিন্তু যুদ্ধের নেশা নারীর নেশার চেয়েও বড়। সেই সময়ে ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে জার্মানির কাছে প্রবল ধাক্কা খাচ্ছে ফ্রান্স। প্রচুর সৈন্য মারা গিয়েছে যুদ্ধে। সেখানে বিশ্বাসঘাতকতার আঙুল উঠছে মাতা হারির দিকে। তাই মাতা হারির চেনা ছকগুলো এবার আর কাজ করল না। যে মেয়ে এমন সুন্দরী, যে এতগুলি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে, যে মেয়ে নগ্নতায় নির্লজ্জ, যাঁর পুরুষসঙ্গী গুনে শেষ করা যায় না, তার কথা বিশ্বাস করল না কেউ। বরং এত সব কিছু মিলিয়ে যে ছবিটা আঁকা হল, তার তলায় ঢাকা পড়ে গেল মাতা হারির অন্য মুখ। এমনকি সেই প্রেমিক ভাদিম মাসলভ, যাঁর জন্য গুপ্তচর হওয়ার ঝুঁকি নিয়েছিলেন মাতা হারি, মুখ ফিরিয়ে নিলেন তিনিও।
১৯১৭ সালের ১৫ অক্টোবর। ফ্রান্সের কুখ্যাত জেলের নোংরা আর দুর্গন্ধ সেলে শোনা গেল ভারী বুটের শব্দ। চমকে ঘুম ভেঙে উঠে বসলেন মাতা হারি। কিন্তু তিনি তো মাতা হারি-ই। যাঁকে দেখলে এককালে চলকে উঠত যে কোনও পুরুষের বুকের রক্ত। তাই মৃত্যুর চোখে চোখ রেখেই বধ্যভূমিতে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়েও চোখ ঢাকলেন না। বুকের দিকে ছুটে এল গুলি। মৃত্যু নিশ্চিত করতে কপালের ঠিক মাঝখানে আর একটা গুলি। লুটিয়ে পড়লেন ‘পৃথিবীর অন্যতম সেরা গুপ্তচর’।
কীভাবে বাঁচতে হয়, মাতা হারি জানতেন। কীভাবে মরতে হয়, সে কথাও জানতেন তিনিই। পৃথিবী তাঁকে ভালবেসেছে, ঘেন্নাও করেছে। কিন্তু উপেক্ষা করতে পারেনি আজও।