মহারাজা থেকে সন্ন্যাসী, কে না জড়িয়েছেন ইলিশের জালে! আর তাঁদের মধ্যেই অন্যতম স্বামী বিবেকানন্দ। জীবন জুড়ে ধর্মের সাধনা করলেও, খাবার পাতে কিন্তু ধর্মকে জড়াতে মোটেই রাজি ছিলেন না স্বামীজি। তাই জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত, ইলিশের গুণ গেয়েছেন তিনি। আসুন, শুনে নেওয়া যাক সে গল্প।
যে সিদ্ধপুরুষ, সে কখনও মাছ খায়? সম্প্রতি খোদ স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে এই প্রশ্ন তুলে বিতর্কে জড়িয়েছেন ইস্কনের অমোঘ লীলা দাস। অথচ একটি পুরোনো সংস্কৃত শ্লোকই দাবি করছে, ইলিশ মাছ নাকি নিরামিষ! তা সে আমিষ হোক কি নিরামিষ, খাবারের মধ্যে কখনোই ধর্মের বেড়া টানতে চাননি স্বামী বিবেকানন্দ। ‘যত মত তত পথ’-এর অনুসারী সন্ন্যাসী তাঁর ধর্মকে লালন করেছিলেন এক মুক্ত অঙ্গনে। যেখানে ধর্ম কথার অর্থ ধারণ করা। সমস্ত ভিন্নতাকে প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে এক সূত্রে গাঁথে সেই ধর্ম। আর তাই, সন্ন্যাস গ্রহণ করে যেমন কৃচ্ছ্রসাধনের পথেও চলেছেন, তেমনই মাছ খেতেও দ্বিধা করেননি স্বামীজি। আর মাছের মধ্যে ইলিশ পেলে দুনিয়া ভুলে যেতেন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীও।
আরও শুনুন: ইলিশ মাছকে নাকি সেকালে ভাবা হত ‘নিরামিষ’! কেন জানেন?
কীরকম? বিবেকানন্দের জীবনী থেকেই জানা যায়, একবার স্টিমারে চড়ে গোয়ালন্দে চলেছেন স্বামীজি। পথে একটা নৌকার দিকে চোখ গেল। জেলেদের জাল জুড়ে রূপসি ইলিশ। আর তা দেখে রীতিমতো উত্তেজিত তিনি। সঙ্গী কানাইকে নির্দেশ দিলেন, টাটকা ইলিশ কিনে নিতে। দলে রয়েছেন মোট সাতজন। তিনটি বা চারটি ইলিশ কিনলেই সকলের হয়ে যাবে, মত সঙ্গীর। স্বামীজি ধমক দিয়ে বললেন, আমরা ক’জন মিলে খাব আর স্টিমারের খালাসি-মাঝিমাল্লারা চেয়ে দেখবে? সন্ন্যাসী তিনি। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছেড়ে পথে বেরিয়েছেন। কিন্তু তার বদলে সারা বিশ্বকেই দুহাতে জড়িয়ে নিয়েছেন যে তিনি। তাই স্টিমারের খালাসিদের কথা অবধি তাঁর চোখ এড়িয়ে যায় না। সেদিন শেষ পর্যন্ত কেনা হয়েছিল ষোলোটি ইলিশ। কত দামে? এক একটি মাছ চার পয়সা করে, তাই মোট দাম পড়ল এক টাকা। এবার স্বামীজির আকাঙ্ক্ষা: ‘পুঁইশাক হলে বেশ হত, সঙ্গে গরম ভাত।’ স্টিমার এক গ্রামের পাশে দাঁড় করিয়ে এক গ্রামবাসীর বাগান থেকে আনা হল পুঁইশাক। আর ইলিশের মুড়ো দিয়ে সেই শাক খেয়ে আহ্লাদিত স্বামী বিবেকানন্দ কী করলেন? ফেরার পথে দীক্ষা দিয়ে গেলেন পুঁইশাকের মালিককেই।
ইলিশের প্রতি বরাবরই এমন প্রাণের টান তাঁর। ১৯০১ সালের ৬ জুলাই বেলুড় মঠে বসেই ক্রিস্টিনকে চিঠিতে সে কথা লিখেছিলেন বিবেকানন্দ। আষাঢ়ের আকাশ, তার নিচে বিছিয়ে আছে গঙ্গার জল। বেলুড় তখনও সবুজ, তখনও নির্জন। সেই নিশ্চুপ শান্তির মধ্যেও সন্ন্যাসীর কাজ ভুলিয়ে দেয় জেলেদের ইলিশ ধরার আনন্দ। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, “নদীতে ইলিশ উঠেছে। লিখছি আর দেখছি। ঘরের গায়ে ঢেউ ধাক্কা খেয়ে উছলে উঠছে। নিচে শত শত মাছ ধরার নৌকা সবাই ধরায় ব্যস্ত।” সঙ্গে ইলিশের দরাজ প্রশংসা করে বিদেশিনি শিষ্যাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, পৃথিবীতে এমন জিনিসটি হয় না।
আরও শুনুন: মাছ ভালোবাসতেন সাহেবরাও, বর্ষার কলকাতায় বেরোতেন মাছ ধরতে
আর এর পরের বছর? মঠে কেনা হয়েছিল সে বছরের প্রথম ইলিশ। তার দাম নিয়ে খুনসুটি করেছেন স্বামীজি। প্রমাণ মাপের ইলিশ দেখে পূর্ববঙ্গীয় শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে ডেকে বলেছেন, ‘তোরা নূতন ইলিশ পেলে নাকি পূজা করিস, কী দিয়ে পূজা করতে হয় কর।’ স্বামী প্রেমানন্দ লিখেছেন, ‘…আহারের সময় অতি তৃপ্তির সহিত সেই ইলিশ মাছের ঝোল, অম্বল, ভাজা দিয়া ভোজন করিলেন।’ তৃপ্তিভরে খেয়ে উঠে আবার মজা করে বললেন, ‘একাদশী করে খিদেটা খুব বেড়েছে, ঘটিবাটিগুলো ছেড়েছি কষ্টে।’
সেদিন ১৯০২ সালের ৪ঠা জুলাই। সেই দিনই শেষবারের মতো মধ্যাহ্নভোজন করেছিলেন স্বামীজি। এই লৌকিক পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার দিনেও তিনি জিভে জড়িয়ে নিয়েছিলেন ইলিশ মাছের অলৌকিক স্বাদ। ইলিশ মাছেই শেষবারের মতো তৃপ্তির আহার সেরেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ।