হতাশ যুবক বসে আছেন একা। সামনে ছুটে চলেছে কর্মমুখর কলকাতা। জীবনের অফুরন্ত উচ্ছ্বাস। আর তার মধ্যে যুবকটি যেন একখানা পথভোলা মেঘ। প্রতিষ্ঠার নক্ষত্রলোক থেকে দূরে শপভ্রষ্ট ঋষিপুত্রের মতোই তিলোত্তমার পারে বসে আছেন তিনি। আর তখনই দেখা হল তাঁর সঙ্গে। গেরুয়া বসনধারী। দীর্ঘ চেহারা। অদ্ভুত চাউনির সেই সন্ন্যাসী।
বাঙালির অভিধানে সাফল্যের সমার্থক যদি কোনও শব্দ থেকে থাকে, তবে তা নিশ্চিতই- উত্তমকুমার। ছাপোষা বঙ্গজীবন স্বাধীনতা পরবর্তী কয়েক দশকে এমন অলীক মানুষ আর দ্বিতীয়টি দেখেনি। দেখার প্রত্যাশাও করে না। রীতি-নীতি, রাজনীতি, ঘর-গেরস্থালি কতকিছুই না বদলে গিয়েছে বাঙালির। দশকের পর দশকের ঢেউ এসে তাকে বিন্যস্ত কিংবা অবিন্যস্ত করেছে। তবু বাঙালির হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ যদি কারও জন্য তোলা থাকে, তবে তিনি উত্তমকুমার। বাঙালি তাঁকে রক্তমাংসের মানুষ হিসাবে ভাবতে ভালবাসে না। বরং একটা গোটা জাতির গহনমনের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা আর ইচ্ছাপূরণের নক্ষত্র হয়ে তিনি যেন হয়ে উঠেছেন এক অতিকথা। যাঁর ভুবনভোলানো হাসিটুকুর কাছে বাঙালি বন্দক রেখেছে তার হতাশা, অপ্রাপ্তির ঘরোয়া কিসসাসমূহ।
এই যে তিনি চিরকালের স্বপ্নের নায়ক, উন্নীত হয়েছেন প্রায় এক অলীক বাস্তবতার পর্যায়ে, তার নেপথ্যে তো থেকে গিয়েছেন একজন রক্তমাংসের মানুষ-ই। যাঁর কথা আমরা কম জানি বা জানার চেষ্টা কম করেছি। আমাদের স্বপ্নের সওদাগর হয়ে তিনি পর্দায় আমাদের জন্য রচনা করে গিয়েছেন মায়াপৃথিবী; আর সেই জাদুপৃথিবীর আড়ালে যে-মানুষটি একান্তে দাঁড়িয়ে থাকতেন, তিনি বোধহয় আমাদের চেনা উত্তমকুমার নন। তিনি অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়। একদা একাকী এক উদভ্রান্ত যুবক। যে যুবকের চোখে স্বপ্নের মায়াকাজল আর হতাশার মেঘ খেলা করত যুগপৎ। ফিল্মে নামার ইচ্ছা যুবকটির। কিন্তু তিনি কি পারবেন? সুযোগ কোথায়! চাকরি একটা করেন বটে। কিন্তু সে কাজ করতে তাঁর ভালো লাগে না। মন যেন চাইছে অন্য কিছু। তিনি পৌঁছাতে চান অন্য কোনওখানে। কিন্তু কে দেবে পথের সন্ধান! জীবনে প্রেম আছে। আছেন প্রেমিকাও। সেখানেও যেন দুরাশার অন্ধকার। কেননা প্রেমিকা বড়লোকের কন্যা। ফলত আগামী জীবন আদৌ প্রেমের সোনার ধানে ভরে উঠবে কি-না, যুবকটি যেন তা বুঝে উঠতে পারেন না। জীবন যেন তাঁকে নিয়ে এক্কাদোক্কা খেলছে। যুবকটির ক্লান্ত লাগে। একা লাগে খুব।
আরও শুনুন: গুন্ডাদের চোখে চোখ রেখে এগোলেন উত্তমকুমার, তারপর…
হতাশ সেই যুবক তাই বসে আছেন একা। সামনে ছুটে চলেছে কর্মমুখর কলকাতা। জীবনের অফুরন্ত উচ্ছ্বাস। আর তার মধ্যে যুবকটি যেন একখানা পথভোলা মেঘ। প্রতিষ্ঠার নক্ষত্রলোক থেকে দূরে শপভ্রষ্ট ঋষিপুত্রের মতোই তিলোত্তমার পারে বসে আছেন তিনি। আর তখনই দেখা হল তাঁর সঙ্গে। গেরুয়া বসনধারী। দীর্ঘ চেহারা। অদ্ভুত চাউনির সেই সন্ন্যাসী। যুবকটির মন এক লহমায় পড়ে নিয়ে তিনি জানতে চাইলেন, কী হয়েছে? কী আবার হবে! হতাশ যুবক তখন নিজের স্বপ্ন আর স্বপ্নপূরণের ব্যালান্স-শিট মেলাতে মশগুল। আনমনে বলে দিলেন, বাবা কিছু হবে না, সরে পড়ো! যুবকটি ভেবেছিলেন, হয়তো পাওনা-গণ্ডার আশায় এসেছেন ওই বাবাজি। এরপর যেন শুরু হল অলৌকিকের খেলা। সন্ন্যাসী বলে চললেন, হবে না মানে কী! নিশ্চিতই হবে। কী হবে?- যুবকের পালটা জিজ্ঞাসা। স্মিত হেসে তিনি বললেন, একটু ঘোরাঘুরি করেই হতাশ হয়ে পড়লে! এবার বিস্ময়ের পালা! যুবকটি তখন ফিল্মে নামার জন্য দোরে দোরে ঘুরছেন। কিন্তু পথ আর পাচ্ছেন না। সেই জন্যই তো হতাশা। কিন্তু সন্ন্যাসী সে-কথা জানলেন কী করে! মনের কথা তিনি জানেন তো বটেই, সেই সঙ্গে বলেও দিলেন, একদিন যে কিনা বড় অভিনেতা হবে, সে ভাবছে ফিল্মে নামার কথা! সন্ন্যাসীকে পরীক্ষা করা জন্যই উলটো কথা বললেন যুবক। তাতে কী! সন্ন্যাসী হেসে বলে দিলেন, যুবকটি অভিনয় করতে চান বা না-চান, ফিল্মে তাঁকে নামতেই হবে। আর যে মেয়েটি তাঁর মনের আকাশ জুড়ে রয়েছে, সে-মেয়েটি ভবিষ্যতে থাকবে তাঁর জীবন জুড়েও। সন্ন্যাসীর বিভায় তখন ক্রমশ আচ্ছন্ন যুবকটি। সন্ন্যাসী আরও বলে গেলেন, আশা-নিরাশার চক্র এই জীবন। তাই বলে ভেঙে পড়তে নেই। যদি আঘাত আসে, জানবে, সফলতা তার পিছনেই আছে। যেমন অন্ধকার মুছে আসে দিন। আর একটা পরামর্শ দিলেন তিনি। যুবক তো উপবীতধারী ব্রাহ্মণ। যেন দু-বেলা গায়ত্রী মন্ত্র জপ করা না ছাড়েন।
একটু আগেই সন্ন্যাসীর পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছিলেন যুবকটি। এবার আচ্ছন্ন ভাব কাটিয়ে যুবক পকেট হাতড়াচ্ছেন। সন্ন্যাসীকে কিছু দেবেন বলে। হাতে উঠে এল একটা পাঁচ টাকার নোট। দিতে যাবেন বলে যেই মুখ তুলেছেন, দেখেন কোথায় সেই সন্ন্যাসী! তিনি নেই। খুঁজতে খুঁজতে ইডেন গার্ডেন্স অব্দি চলে এলেন, কিন্তু সেই সন্ন্যাসীর আর দেখা পেলেন না। তবে, সন্ন্যাসীর পরামর্শ তিনি অমান্য করেননি। তাঁর মা তো তাঁকে কতবার বলেছেন গায়ত্রী জপ করতে। সন্ন্যাসীও একই কথা বললেন। অতএব সকালের আলো ফুটতেই যুবক ডুবে গেলেন গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণে, ধ্যানে। পৃথিবীতে কি অলৌকিক ঘটে! হয়তো ঘটে। যুবকের জীবনই তো তার সাক্ষী। ফিল্মে নামার জন্য একদা কতই না ঘুরেছেন! আচমকা সেই সুযোগ এল এই ঘটনার ঠিক কয়েকদিন পরেই। ছবির নাম ‘মায়াডোর’। এল বহু প্রার্থিত সেই অভিনয়ের সুযোগ।
উত্তমকুমার নামে বাঙালির অলৌকিক এই সাফল্যগাথার নেপথ্যে চিরকাল থেকে গিয়েছেন সেদিনের সেই যুবকটি। যিনি তাঁর নামটুকু পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছিলেন। অরুণকুমার হয়েছিলেন উত্তমকুমার– উত্তম-মানুষের পুত্র। সত্যি বলতে, উত্তমকুমার নামক এই মিথটি তো শুধু অরুণকুমারের একার নয়। তা রচনা করেছেন মানুষ। বহু মানুষের সম্মিলিত স্বপ্ন কায়া পেয়ে যে মানবমূর্তি রচিত হয়েছে, তারই নাম উত্তমকুমার। সেই উত্তম আলোর আড়ালে থেকে গেলেন সেদিনের যুবক। সেই অলৌকিক কয়েক মুহূর্ত। আজ আমাদের মনে হয়, ভাগ্যিস হতাশ যুবককে সেদিন আশার আলো দেখিয়েছিলেন সন্ন্যাসী! যুবক সেদিন সেই মহাপুরুষের দেখা পেলেন বলেই বাঙালিও পেয়ে গেল তার চিরকালের প্রাণের পুরুষকে… উত্তমকুমারকে।