রাজনৈতিক ভাবে কোনোদিনই কূপমণ্ডুক নয় বাংলা। সেই ঘরানা যেন এদিন একুশের মঞ্চে ফেরালেন মমতা। তার সূত্র হয়ে থাকল মণিপুরের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি। এর আগেও কবি সুবোধ সরকারের ‘মণিপুরের মা’ হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের মুখর ভাষ্য। আজ যখন মণিপুর নিয়ে আবার উদ্বেগ ঘনিয়ে উঠেছে, তখন বাংলার মাটি থেকেই উঠে এল প্রতিবাদের বয়ান।
একুশে জুলাই। শহিদ স্মরণে উৎসর্গ করা একটা দিন। খাতায়-কলমে দিনটি তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক সমাবেশের। তবে নির্দিষ্ট একটি দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরেও বৃহত্তর তাৎপর্য বয়ে আনল এবারের সমাবেশ। মণিপুর নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে যে বার্তা দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তা যেন অন্য মর্যাদা দিল এবারের সমাবেশকে।
আরও শুনুন: বলতে হবে ‘জয় শ্রীরাম’, ইমামকে গেরুয়া চাদর পরিয়ে নির্দেশ, যোগীরাজ্যের ঘটনায় ফের বিতর্ক
কেন এই প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে? অশান্তি-হিংসায় দীর্ঘদিন ধরেই দীর্ণ মণিপুর। এতদিন তা নিয়ে কেন্দ্র প্রায় নীরবই থেকেছে। সম্প্রতি এক ভাইরাল ভিডিও-কে ঘিরে তোলপাড় হয়েছে গোটা দেশ। গোষ্ঠীহিংসা গিয়ে পৌঁছেছে নারীশরীরে। এতদিনে সরব হয়েছে গোটা দেশ। নানাদিক থেকে উঠে আসছে প্রতিবাদ। সারা দেশের অভিমুখই যেন ঘুরে গিয়েছে মণিপুরের দিকে। ঠিক সেই মুহূর্তেই বাংলার মাটি থেকে মণিপুরের মায়েদের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করলেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলা যায়, বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে এক রাজনৈতিক সমাবেশে মণিপুর ইস্যুকে দারুণ ভাবে প্রাসঙ্গিক করে তুললেন তিনি।
রাজনৈতিক ভাবে এই বার্তার অন্য গুরুত্ব আছে। সম্প্রতি সমমনস্ক বিরোধী দলগুলি মিলে তৈরি হয়েছে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’। সেই জোটের মধ্যমণি মমতা। ফলত রাজনৈতিক ভাবে এ নিয়ে তাঁর সরব হওয়ার মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই। এর আগেও তিনি মণিপুরে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন অনুমতি মেলেনি। এখন তাঁর ইচ্ছা, বিরোধী জোটের মুখ্যমন্ত্রীরা মণিপুরে যান। এ নিয়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সঙ্গেও তাঁর কথা হয়েছে বলে মঞ্চ থেকেই তিনি জানিয়েছেন। সে পরিকল্পনা আদৌ বাস্তবায়িত হবে কি না, তা আলাদা প্রসঙ্গ। তবে রাজ্যের এক রাজনৈতিক সমাবেশে যেভাবে উঠে এল মণিপুর প্রসঙ্গ তা বাংলার রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যকেই যেন আরও একবার প্রাঞ্জল ভাবে তুলে ধরল।
আরও শুনুন: গুপ্তচর প্রশ্নে নয়া তথ্য ফাঁস! বেনামে ভারতে অনুপ্রবেশ গেম-প্রেমের পাক বধূর, ব্যবহার ভুয়ো পরিচয়পত্রও
এই বাংলা রাজনৈতিক ভাবে কোনোদিনই কূপমণ্ডুক ছিল না। নিজস্ব সীমানা পেরিয়ে দেশ ও বিশ্ব নিয়ে বাঙালি ও বাংলার রাজনীতি বরাবরই ছিল সচেতন। বাঙালির শিল্প-সাহিত্য এই রাজনৈতিক সচেতনতার বাইরে ছিল না। রাশিয়া, চিন থেকে ভিয়েতনাম- বিশ্বের রাজনীতি এসে মিশেছে বাংলার রাজনৈতিক প্রজ্ঞায়। বাংলার নেতারা শুধুমাত্র আঞ্চলিক রাজনীতিতে মেতে থাকেননি। বরং তাঁদের রাজনৈতিক চেতনায় মিশে গিয়েছে বিশ্বচেতনাও। স্বদেশ ও সমকাল বরাবর গুরুত্ব পেয়েছে তাঁদের রাজনৈতিক চিন্তায়। বাংলার মানুষও এই প্রসারিত রাজনৈতিক সচেতনাতেই বিশ্বাস রেখেছে এতদিন। সেই ঘরানা যেন এদিন একুশের মঞ্চে ফেরালেন মমতা। তার সূত্র হয়ে থাকল মণিপুরের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি। এর আগেও যখন মণিপুর খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিল, তখন কলম ধরেছিলেন বাংলার কবি। কবি সুবোধ সরকারের ‘মণিপুরের মা’ হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের মুখর ভাষ্য। বাংলার মানুষ সময়ের এই অভিঘাত নিয়ে সচেতন। তাই আজ যখন মণিপুর নিয়ে আবার উদ্বেগ ঘনিয়ে উঠেছে, তখন বাংলার মাটি থেকেই উঠে এল প্রতিবাদের বয়ান। প্রতিবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সারা দেশেই সুপরিচিত। একুশের মঞ্চ যেন সেই চেনা মমতাকেই ফিরিয়ে দিল। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে এদিন স্বভাবসিদ্ধ ভাবে আক্রমণ শানিয়েছেন মমতা। তবে, মণিপুর ইস্যুকে শুধু কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আক্রমণের আওতায় সীমায়িত করে রাখা যায় না। এদিন মমতা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁর থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল বাংলার সুনাম ও সম্মান। রাজনৈতিক ভাবে তাঁর বিরোধিতা চলতেই পারে। সে নিয়ে আপত্তি নেই তাঁর। কিন্তু সেই বিরোধিতা যেন বাংলার সুনামহানি না করে। এদিন মণিপুর নিয়ে যেভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন মমতা, তা যেন বাংলার নিজস্ব রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যকেই তুলে ধরল। কলকাতার মাটিতে বাংলার এক রাজনৈতিক দলের সমাবেশে যেভাবে মণিপুর প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল, তা বাংলার রাজনীতির ঐতিহ্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সমালোচনা করে বলা যায় যে, নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এ নিয়ে সরব হয়েছেন মমতা। সে সমালোচনা একেবারে অমূলক নয়। কিন্তু বাংলার রাজনীতি ও রাজনৈতিক সচেতনতা যে বৃহত্তর ও প্রসারিত, মণিপুরের মায়েদের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়ে সেই কথাটিকেই আরও একবার তুলে ধরলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তা যদি রাজনীতির খাতিরেও হয়ে থাকে, তা-ই বা মন্দ কী! বাংলার রাজনীতি যে বাংলার সীমানা পেরিয়েও নানা রাজনৈতিক ভাবনায় আজও অভ্যস্ত, সেই সত্যিই যেন আরও একবার স্পষ্ট হল বৃষ্টিভেজা বাংলায়। আঞ্চলিকতা আর প্রাদেশিকতার গণ্ডি পেরিয়ে এই প্রাপ্তিটুকু কিন্তু একেবারে হেলাফেলার নয়।