টেনিদা চরিত্রের কাস্টিংয়ে সবসময়েই এমন কোনও অভিনেতারই ডাক পড়ে, যিনি সিনেজগতে কমেডি অভিনেতা হিসেবেই খ্যাত। কিন্তু টেনিদা মানে কি কেবলই হাসি তামাশা? নাকি হাসির আড়ালে সমাজের অসংগতিগুলোকে প্রশ্ন করার হাতিয়ারও?
প্রোমোটার রাজের দাপটে পাড়ার রক অতীত বহুদিনই। লোকজনের আড্ডা দেওয়ার জায়গা বলতে এখন কেবল সোশ্যাল মিডিয়া। আর এই সোশ্যাল মিডিয়াতেই আপাতত ছড়িয়ে পড়েছে একটি নতুন বাংলা ছবির ট্রেলার, যার নাম ‘টেনিদা অ্যান্ড কোং’। ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপের যুগে ফের ফিরে এসেছে বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় চরিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা। পরিচালকের অবশ্য দাবি, ভারচুয়ালের যুগ হলেও এই টেনিদা তার সঙ্গে তাল মেলায়নি মোটেও। টাইমলাইন বদলে গেলেও টেনিদা, প্যালা, ক্যাবলা আর হাবুল সেন-রা রয়ে গিয়েছে সেই ফেলে আসা সময়েই। আর তাদের হাসিঠাট্টা, একে অপরের লেগপুলিং, এই সবকিছুকেই ছবিতে ধরতে চাওয়া হয়েছে বলে জানাচ্ছেন ছবির কলাকুশলীরা। আর প্রশ্ন উঠছে ঠিক এখান থেকেই। টেনিদার গল্প মানে কি কেবলই হাসি আর তামাশা? অন্তত তেমনটাই কি মনে করে বাংলা ছবির দুনিয়া? না হলে টেনিদা চরিত্রের কাস্টিংয়ে সবসময়েই কেন এমন কোনও অভিনেতারই ডাক পড়ে, যিনি সিনেজগতে কমেডি অভিনেতা হিসেবেই খ্যাত?
উমানাথ ভট্টাচার্যের পরিচালনায় ১৯৭৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল টেনিদার প্রথম ছবি ‘চারমূর্তি’। যেখানে টেনিদা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন চিন্ময় রায়। ২০১১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আরও একটি ছবিতে অভিনয় করেন শুভাশিস মুখোপাধ্যায়। আর এই ২০২৩ সালের টেনিদা চরিত্রে ডাক পড়েছে কাঞ্চন মল্লিকের। এই তিন অভিনেতাকেই বাঙালি সিনে দর্শক চেনে মূলত হাস্যরসের অভিনেতা হিসেবেই। চেহারার দিক দিয়েও দুজনের সঙ্গে গল্পের টেনিদার বিন্দুমাত্র মিল নেই। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কল্পনায় টেনিদা ছ-ফুট লম্বা তাগড়াই জোয়ান, খেলাধুলো আর মারপিটের আসরে যাকে সবসময় দেখা যায়। গড়ের মাঠে গোরা পিটিয়ে বিখ্যাত সেই টেনিদার সঙ্গে শারীরিক আকৃতির দিক দিয়ে পর্দার টেনিদাদের মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু বহিরঙ্গের কথা যদি বাদও দিই, চরিত্রের অন্তর্নিহিত সুরটিও কি বজায় রেখেছে টেনিদার চলচ্চিত্রায়ন?
টেনিদার গল্পের হাসি-তামাশা সরিয়ে একটু খেয়াল করলেই আরও একটা ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একা ক্যাবলা ছাড়া চারমূর্তির আর কেউই পড়াশোনায় বিশেষ ভাল নয়। তবে যৌথ পরিবারে মারধর বা ব্যঙ্গবিদ্রুপের পাশাপাশি খাবারটুকু ঠিকই জুটে যায় তাদের। কিন্তু সেই আশ্রয়টাও কি খুব নিরাপদ? ‘দি গ্রেট ছাঁটাই’ গল্পে প্যালা ছোটকাকার অফিসে ছাঁটাইয়ের কথা বলে। বিশ্বযুদ্ধের জন্য যে ছাপোষা গৃহস্থের ভাঁড়ারেও টান পড়েছে, তা উঠে আসে একাধিক গল্পেই। ‘খট্টাঙ্গ ও পলান্ন’ গল্পে টেনিদা বলে রেশনের চালে কাঁকরের কথা। রোজগারের আর কোনও উপায় খুঁজে না পেয়ে ভজহরি ফিল্ম কর্পোরেশন নামে চিটফান্ড খুলে বসে টেনিদা ও প্যালা। আবার সেই সময় থেকেই ছোটদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের দিকটি যে ক্রমে ক্রমে অবহেলার মুখে পড়ছে, তাও বুঝতে ভুল হয় না। ‘চারমূর্তির অভিযান’ গল্পে প্যালা নিজের কলেজ সম্পর্কে লেখে, ‘আমাদের সিটি কলেজ খুব ভালো। খালি ছুটি দেয়। আজও চড়কষষ্ঠী না কোদালে অমাবস্যা- কীসের একটা ছুটি ছিল।’ মনে রাখা ভাল, এই কলেজেই দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন লেখক নিজেও। শিক্ষাজগতের সামগ্রিক অব্যবস্থার কথা তাঁর অজানা ছিল না। আর শুধু শিক্ষাই নয়, ছোটদের বৌদ্ধিক বিকাশের পাশাপাশি শারীরিক কসরতের দিকেও একইরকম অবহেলার ছাপ পড়ছিল। তাই ডাম্বেল বারবেল কেনার জন্য পাড়ার লোকের কাছে চাঁদা চাইতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েই ফিরে আসতে হয় প্যালা-ক্যাবলাদের। বোঝা যায়, বিশ শতকের শুরুতে স্বদেশি আন্দোলনের সূত্র ধরেই বাংলা জুড়ে লাঠিখেলা, তরোয়াল খেলা, শরীরচর্চার যে অভ্যাস শুরু হয়েছিল; বিশ্বযুদ্ধ-মন্বন্তর-দাঙ্গা-দেশভাগের পর বিধ্বস্ত বাঙালি রোজের খাবারটুকু খুঁটে নিতে নিতে সেই বিকাশের পথটাই হারিয়ে ফেলেছে। আর ১৯৫৭ সাল থেকে টেনিদাকে নিয়ে একের পর এক গল্প উপন্যাসের স্তরে স্তরে সেই সমাজের ছবিটাই বুনে দিয়েছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। সমাজের যে দোষগুলো টেনিদার গল্পে যুব প্রজন্মের চোখ দিয়ে দেখে ঠাট্টাতামাশা করা হচ্ছিল, কয়েক বছর বাদে তাই নিয়ে ক্ষোভ ক্রমশ পুঞ্জীভূত হতে হতে ফেটে পড়বে নকশাল আন্দোলনে, মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’, তপন সিংহের ‘এখনই’ বা সত্যজিতের ‘জনঅরণ্য’ ছবিতে বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ উপন্যাসে।
সত্তরের দশকে যখন টেনিদাকে প্রথমবার পর্দায় তুলে ধরা হয়, সমাজের জমে থাকা এই ক্ষোভ ততদিনে আর চাপা নেই। আর এই সময়ে দাঁড়িয়ে সেই ক্ষোভ বহু মুখে নিজেকে উগরে দিচ্ছে। শিক্ষাজগতের বেহাল দশা, বেকারত্ব, দুর্নীতি, চিট ফান্ড কিংবা সিনেমায় সুযোগ দেওয়ার নামে অন্যায় সুযোগ নেওয়া, দিনযাপনের মতো উপার্জনটুকু করে উঠতেই মাথার ঘাম পায়ে ফেলা- সময়টা আরও কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে। এই সময়ে হাসির আড়ালে গোটা সমাজের ছবিটা তুলে ধরার হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে টেনিদার গল্প। কারণ, যে জনগণেশের হাতে আর কোনও ক্ষমতাই নেই, ক্ষমতাহীনের দিকে তাকিয়ে ঠাট্টাই তো কেবল ছুড়ে দিতে পারে তারা। ঠাট্টাই তো এখন করা যায়। আর ঠাট্টা তো এখনই করা যায়। কিন্তু পর্দার টেনিদা সেই হাতিয়ার হয়ে উঠবে কি? প্রশ্ন কিন্তু রয়েই যাচ্ছে।
[ছবি: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়]