শাড়িতেই নারী। বিজ্ঞাপনী প্রচারে এমনটা প্রায়শই দেখা যায়। ভারতীয় নারীর ছবি কল্পনা করতে বললে, অনেকেই হয়তো শাড়ি পরিহিতা কাউকে কল্পনা করবেন। সেই হিসেবে যে দুটি দেশ একসময় ভারতের অংশ ছিল, অর্থাৎ পাকিস্তান ও বাংলাদেশ, সেখানেও এই চল থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ সেই শাড়ি পরার অভ্যাস ধরে রাখলেও, পাকিস্তান এই পোশাককে সম্পূর্ণ নাকচ করেছিল। ধর্মের দোহাই দিয়েই ইসলামিক দেশটিতে নিষিদ্ধ হয়েছিল এই পোশাক। এখনও কি সেই নিষেধ একইভাবে মানা হয়? আসুন শুনে নিই।
ভারতীয় বিয়ে মানেই কনের পরনে থাকবে বেনারসি কিংবা ওই জাতীয় কোনও জমকালো শাড়ি। শুধু বিয়ে কেন, যে কোনও আচার অনুষ্ঠানেই ভারতের নারীদের মূলত শাড়ি পরেই দেখা যায়। এমনকি কানের রেড কার্পেট থেকে ওপরা উইনফ্রে-র বিখ্যাত শো, সব জায়গাতেই একাধিক ভারতীয় তারকাকে দেখা গিয়েছে শাড়িই পরতে। কিছুদিন আগে রেড কার্পেটে ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই জামদানি পরে সবার নজর কেড়েছিলেন বাংলাদেশের অভিনেত্রী আজমেরি হক বাঁধন। কিন্তু ভারতের অন্য পড়শি দেশ পাকিস্তানে কিন্তু শাড়ি পরার কথা ভাবতেন না প্রায় কোনও মহিলাই। আসলে ধর্মের দোহাই দিয়েই ইসলামিক দেশটিতে নিষিদ্ধ হয়েছিল এই পোশাক।
কিন্তু কেন?
সে ইতিহাস জানতে গেলে, ফিরে দেখতে হবে মুক্তিযুদ্ধের সময়টাকে। তার আগে অবধি পাকিস্তানি মহিলাদের মধ্যে শাড়ির পরার চল ছিল যথেষ্টই। এমনকি বিভিন্ন বিজ্ঞাপনেও শাড়ি পরিহিতা মহিলাদেরই দেখা যেত। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ছবি রীতিমতো বদলে যায়। পূর্ব পাকিস্তান এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ রাজনৈতিক ভাবে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। এই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই মহিলা ছিলেন। আর তাঁরা প্রত্যেকেই শাড়ি পরে মার্চ করতেন। একে তো মহিলা, তার ওপর বিরোধী পক্ষ। তাঁদের এই দাপট কিছুতেই সহ্য করতে পারেননি পাকিস্তানের কর্তাব্যক্তিরা। এমনিতেই ইসলামের দোহাই দিয়ে মেয়েদের পর্দা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আর এবার হিন্দু ধর্ম, বা বলা ভাল ভারতের সবরকম ছাপ দেশ থেকে মুছে ফেলতে উঠেপড়ে লাগে পাক সরকার। জেনারেল জিয়া উল হক সর্বপ্রথম এই পোশাক নিষিদ্ধ করার জন্য গর্জে ওঠেন। দেশের প্রায় সমস্ত সরকারি ক্ষেত্রে শাড়িতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন তিনি। তাঁর যুক্তি ছিল, এই পোশাকে মহিলাদের মুসলিম নয়, ভারতীয় বলে মনে হয়। ভয় বিশ্বাস দেশভক্তি, সবকিছুর প্রভাব পড়ে শাড়ির উপর। দেশের যেসব মহিলারা এই পোশাকে যথেষ্ট স্বচ্ছন্দ ছিলেন, শাসকের প্রতি ভয়েই হোক কি আনুগত্যে, তাঁরা ধীরে ধীরে শাড়ি পরা প্রায় বন্ধ করে দেন। সব মিলিয়ে পাকিস্তানিদের জীবন থেকে শাড়ি একপ্রকার উধাও হয়ে যায়।
তবে বর্তমানে সেই ছবি অনেকটাই বদলেছে। আগের তুলনায় বিভিন্ন দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান বেড়েছে। ধর্মীয় বিশ্বাস ভেঙে যুক্তি দিয়ে বুঝতে শুরু করেছেন অনেকেই। এমনই কিছু মহিলার হাত ধরে পাকিস্তানে শাড়ি পরার চল আবারও ফিরে এসেছে। সম্প্রতি বিখ্যাত এক পাকিস্তানি গানে এক মহিলাকে শাড়ি পরেই নাচতে দেখা গিয়েছে। অনেকেই সেই ছবি দেখে প্রথমে অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু নৃত্যশিল্পীর দাবি, এতে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। একটি পোশাক যে কেউই পরতে পারেন, সেখানে দেশ ধর্ম জাতির বেড়া তোলার কোনও মানে হয় না। এই মতের সপক্ষে সওয়াল করেছেন আরও অনেকেই। বিশেষত সে দেশের অভিজাত মহিলাদের অনেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শাড়ি পরে যেতেই পছন্দ করেন। সরকারি ক্ষেত্রেও ফিরে এসেছে শাড়ির চল। পাক শিল্পীদেরও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শাড়ি পরতে দেখা যায়। অনেকেই মনে করছেন, ধীরে ধীরে এই পোশাক আবারও পাকিস্তানে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। আর এই বিপ্লব আনবেন দেশের মহিলারাই।