শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ, এমন কথা বলে থাকেন দেশবিদেশের শিক্ষাবিদরাই। কিন্তু মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ দূরে থাক, মাতৃভাষাকে মাধ্যম করে পড়াশোনা করা কোনও পড়ুয়াকেই কলেজে প্রবেশাধিকার দিতে নারাজ এক প্রতিষ্ঠান। তাও কিনা খোদ কলকাতার বুকেই। বাংলার বুকেই কি তাহলে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছে বাংলা ভাষা? লরেটো কলেজের এহেন নির্দেশে নতুন করে উসকে উঠল এই প্রশ্ন। ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানালেন শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার, শুনলেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
বড় মাছ যখন ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে, তাকে বলা হয় মাৎস্যন্যায়। এই একই আগ্রাসন চলে ভাষার ক্ষেত্রেও। যে ভাষা ও সংস্কৃতি তুলনামূলক ভাবে বেশি বলবান, যার পুঁজির জোর বেশি, সে অন্যান্য ভাষা ও সংস্কৃতিকে ক্রমশ গিলে নিতে চায়। কায়েম করতে চায় নিজের একাধিপত্য। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে যে এমনটাই ঘটছে, সে কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। কখনও হিন্দি, কখনও ইংরেজির আগ্রাসনে ক্রমশ দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে বাংলার। হ্যাঁ, খোদ বাংলার বুকেও অবস্থাটা বিশেষ আলাদা নয়। এর আগে কলকাতাতেই একাধিক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে যে স্কুলের ভেতরে বাংলা শব্দ উচ্চারণ করলেও জরিমানা করা হবে, একাধিক চাকরিতে অলিখিত নিয়মই রয়েছে যে বাংলা মাধ্যমের সেখানে প্রবেশ নিষেধ, এমনকি নেহাত শিশুদের গৃহশিক্ষক খুঁজতে হলেও কনভেন্টশিক্ষিত তরুণ-তরুণীর খোঁজ করছেন ইদানীং কালের অনেক মা-বাবাই। সেই গল্পেই এবার নতুন পাতা যোগ করেছে কলকাতার নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান লরেটো কলেজ। স্নাতকে ভরতির বিজ্ঞপ্তিতে কলেজ কর্তৃপক্ষের সাফ ঘোষণা, যেহেতু ক্লাসে পড়ানো হবে ইংরেজি ভাষায়, এমনকি লাইব্রেরির বইগুলিও ইংরেজি, সুতরাং ইংরেজি মাধ্যমে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলে তবেই ভরতির আবেদন করা যাবে কলেজে। আর এই বিজ্ঞপ্তি সামনে আসতেই তোলপাড় নেটমাধ্যমে।
আরও শুনুন: পড়ুয়াদের প্রতি বিশ্বাস নেই! খর্ব স্বাধীনতাও! প্রেসিডেন্সির নয়া নিয়মে কী মত প্রাক্তনীদের?
বিজ্ঞপ্তিতে যে ‘ভার্নাকুলার’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, সেই ইংরেজি শব্দটি বস্তুত ব্রিটিশদেরই অবদান। যার সঙ্গে জুড়ে আছে নেটিভ শব্দও। ভার্নাকুলার মানে হল নেটিভদের ভাষা। সুতরাং এই শব্দের সঙ্গে যে অবজ্ঞা এবং ঘৃণা জড়িয়ে ছিল, তা বুঝতে ভুল হওয়ার কথা নয়। ১৯১২ সালে ক্যাথলিকদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত লরেটো কলেজ এই ভার্নাকুলার শব্দটিই ব্যবহার করেছে নিজেদের বিজ্ঞপ্তিতে। আধুনিকতা-প্রগতির মোড়কে এই জাতপাত যে এখনও একই মাত্রায় জারি রয়েছে, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার এ প্রসঙ্গে স্পষ্টই বলছেন, সরকারি তরফে স্কুলে বাংলা ভাষা শিক্ষার নির্দেশ চালু না করার ফলেই এই পরিণতি। বাংলা মাধ্যমে পড়লে ইংরেজি শেখা যায় না বা ইংরেজিতে কোনও বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করা যায় না, এ ধারণা একেবারেই ভ্রান্ত। বিদেশের কোনও প্রতিষ্ঠানেই এ ধরনের কোনও নিয়ম নেই বলেই জানালেন তিনি। বাংলা নিয়ে পড়াশোনা করলেও দীর্ঘদিন বৃত্তি নিয়ে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি নিজেও। তাই এই প্রবণতাকে নিছক উচ্চমন্যতা বলেই আক্ষেপ প্রকাশ করছেন এই খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। তাঁর আক্ষেপ, বাংলা মাধ্যমে যাঁরা পড়াশোনা করেছেন, ওই প্রতিষ্ঠান তাঁদের কুষ্ঠরোগগ্রস্ত বা দলিত বললেও হয়তো আশ্চর্য হওয়ার কিছু ছিল না।
তবে পরিস্থিতি কি তাতে পালটাবে? যে বাংলায় ‘আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না’ বলে গর্ব করা শুরু হয়েছে বহুদিনই, যে রাজ্যে একের পর এক সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুল পরিকাঠামোর অভাবে ধুঁকছে বা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সে রাজ্যের শিক্ষাঙ্গনে কি বাংলা ব্রাত্য হয়ে যায়নি বহুদিনই? সেই কথাকেই বুঝি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল লরেটো কলেজের এই ঘটনা।