অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালু করার জন্য উদ্যোগী কেন্দ্র। তা নিয়ে দিকে দিকে বিতর্ক। বিরোধীদের সমালোচনার আঙুল উঠেছে দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দিকেই। কিন্তু একা মোদি নন, এই পদক্ষেপ করতে চেয়েছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুও। সদ্যস্বাধীন দেশেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। কিন্তু তাহলে এই সময়ে দাঁড়িয়ে কেন এই নীতির বিরোধিতায় সরব হচ্ছে কংগ্রেস-এর মতো বিরোধীরা? শুনে নিন।
এক দেশ এক আইন। ধর্মের ভিত্তিতে কোনও আলাদা আইনি ব্যবস্থা থাকবে না দেশে। দেশের আইন ব্যবস্থায় এই পদক্ষেপ করতে তৎপর কেন্দ্র। এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হলে বর্তমানে মুসলিমদের যে নিজস্ব পৃথক দেওয়ানি বিধি চালু রয়েছে, নাকচ হয়ে যাবে সেই বিধিও। অস্তিত্ব হারাবে মুসলিম ল বোর্ড। আর সেইখানেই আপত্তি মুসলিম সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশের। তাই মোদি সরকার অভিন্ন দেওয়ানি বিধি রূপায়ণের উদ্যোগ নিতেই পালটা আন্দোলন শুরু করেছে তারা। এই নয়া ব্যবস্থার বিরোধিতায় সুর চড়িয়েছে কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলগুলিও। আর সেইখানেই উঠে এসেছে পালটা একটি প্রশ্ন। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে নরেন্দ্র মোদিই যে প্রথম কথা বললেন, এমন তো নয়। সত্যি বলতে, ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত এই বিধির সমর্থনে কথা বলেছিলেন জওহরলাল নেহরু স্বয়ং। সদ্য স্বাধীন হয়েছে যে দেশ, সেই দেশে একটিই অভিন্ন আইন লাগু হবে, এমন স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। মেয়েদের অধিকারের পক্ষে বরাবরই সওয়াল করার অভ্যাস ছিল তাঁর। সুতরাং মুসলিম ল বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী তিন তালাক প্রথা, বিবাহসংক্রান্ত অধিকার এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রসঙ্গে মুসলিম মেয়েদের যে অসহায় অবস্থা, তাও নিশ্চয়ই তাঁর চোখ এড়ায়নি। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করা গেলে এই অবস্থার উন্নতি ঘটবে, এমনটাই হয়তো মনে করেছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। আর সেই প্রসঙ্গ টেনে এনেই বিজেপির প্রশ্ন, তাহলে এখন নিছক মোদিবিরোধিতার জন্যই কি উলটো সুর কংগ্রেসের?
আরও শুনুন: ‘হিন্দু দেওয়ানি বিধি’ চালুর উদ্যোগ নিচ্ছেন মোদি! মুসলিমদের হয়ে পালটা সওয়াল ওয়েইসির
কিন্তু ঘটনা হল, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথা বললেও, ভারতের ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে কখনোই অস্বীকার করতে চাননি নেহরু। নেহরু বরং বলেছিলেন, সংখ্যালঘুদের প্রতি শুধু সমদর্শী হলেই চলবে না, তাঁরা যাতে সেটা অনুভব করতে পারেন, তা নিশ্চিত করাও সরকারেরই দায়িত্ব। তাই ভারতীয় সমাজে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করতে চাইলে যে সূক্ষ্ম সমস্যাগুলি দেখা দেবে, সে বিষয়েও রীতিমতো সতর্ক ছিলেন নেহরু। এই প্রসঙ্গেই তিনি বলেছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যা করতে পারে, সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে তা পারে না, তারা সংখ্যালঘু বলেই পারে না। আর এই ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে মান্যতা দিয়েছিল মোদি সরকারের ২১-তম আইন কমিশনও। সম্প্রতি ২২-তম আইন কমিশন যে নতুন করে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিষয়টি খতিয়ে দেখছে, এর উলটো পথে হেঁটে ২১-তম কমিশনের মত ছিল, বিভিন্ন ধর্মের মানুষের জীবনযাত্রার মধ্যে ফারাক থাকতেই পারে। তা আসলে গণতন্ত্রেরই প্রতীক। আর অধিকাংশ দেশই এখন এই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ফারাককে স্বীকৃতি দেওয়ার পথেই হাঁটছে। মূলত এই যুক্তিতেই ২১-তম আইন কমিশনের মত ছিল, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কাঙ্ক্ষিত নয়। তার প্রয়োজনও নেই। ২১-তম আইন কমিশনের এই রিপোর্টের পরে নতুন করে ২২-তম আইন কমিশনের অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন ছিল না, এমনটা মনে করছে কংগ্রেস-সহ অনেক বিরোধী দলই। লোকসভা ভোটের ঠিক আগে আগেই কেন্দ্রীয় আইন কমিশনের এই তৎপরতা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। কংগ্রেস নেতা তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়রাম রমেশ যেমন সাফ জিজ্ঞাসা করছেন, মোদি সরকারের তরফে মেয়াদ বাড়ানোর পরেই কেন বদলে গেল আইন কমিশনের অবস্থান? প্রধানমন্ত্রী সওয়াল করেছিলেন যে, এক পরিবারের সকল সদস্যের জন্য আলাদা আইন থাকতে পারে না। যার পালটা দিয়ে প্রবীণ কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরম বলেছেন, পরিবারের মধ্যেও যে একই রকম ভাবনা থাকে, তা নয়, বরং সেখানেও আলাদা আলাদা ভাবনা অর্থাৎ বৈচিত্র্যের পরিসর থাকে।
আরও শুনুন: বাকিদের মতো কেন ন্যায্য বিচার পাবেন না মুসলিম নারীরা? ‘এক দেশ এক আইনের’ পক্ষে সওয়াল মোদির
আসলে অভিন্নতার মাধ্যমে সমতাবিধান করার অর্থ সব কিছুকেই এক ছাঁচে ফেলে দেওয়া নয়। সম্ভবত এই ভাবনায় জোর দিয়েই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে কট্টর মনোভাব দেখাননি নেহরু। দেশের কোনও নাগরিকের সাংবিধানিক নিরাপত্তা পাওয়ার ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রথা যাতে বাধা না হয়ে দাঁড়াতে পারে, তা নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু অভিন্নতা রক্ষায় জোর দিতে গিয়ে ভারতের বহুত্ববাদী আত্মাটি যাতে খণ্ডিত না হয়, তা নিশ্চিত করাও একইরকম জরুরি। আর সেই বক্তব্যের জোরেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে মত দিতে নারাজ নেহরুর কংগ্রেস-সহ বহু বিরোধী দলই। আসন্ন বাদল অধিবেশনেই এই সংক্রান্ত বিলটি পেশ হতে চলেছে। লোকসভা নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠতে চলেছে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। তাই বর্তমানে দেশ ঠিক কোন পথে হাঁটবে, তা নির্দিষ্ট হয়ে যাবে অচিরেই।