বিপদ থেকে রক্ষা করেন যিনি, তিনিই বিপত্তারিণী। আর সেই দেবী বিপত্তারিণীর পুজোই হল বাংলার নিজস্ব এক ব্রত। মূলত দেবী দুর্গার এক রূপের আরাধনা। নেপথ্যে রয়েছে যে কোনও বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার অভিপ্রায়। মর্তে এই ব্রত শুরু হওয়ার ইতিহাস নিয়ে জনপ্রিয় এক লোককাহিনি প্রচলিত রয়েছে। দেবীর কোন মাহাত্ম্যের বর্ণনা দেয় সেই উপাখ্যান? আসুন শুনে নিই।
দেবী দুর্গার ১০৮ রূপের মধ্যে অন্যতম দেবী সঙ্কটনাশিনীর এক রূপ, দেবী বিপত্তারিণী। দেবী পুরাণে মহামায়ার প্রতিটি রূপের বিশেষ বর্ণনা পাওয়া যায়। যার মধ্যে দেবী বিপত্তারিণীর প্রসঙ্গও রয়েছে। তবে পুরাণের সেই অসুরদলনী দেবী নন। বাংলার ঘরে ঘরে দেবী বিপত্তারিণী পূজিতা হন রক্ষাকর্ত্রী হিসেবে। পুজোর পর বিশেষ এক আশীর্বাদি সুতো বা ধাগা ভক্তরা হাতে বাঁধেন। মনে করা হয়, এই সুরক্ষাকবচ যে কোনও বিপদ থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখে।
আরও শুনুন: ছয় মাথা, আঠারো চোখ, দেবী কামাখ্যার এমন রূপের মাহাত্ম্য কী?
জগন্নাথের রথযাত্রার পরের মঙ্গল-শনিবার হয় বিপত্তারিণী চণ্ডীর পূজা। ঘরে ঘরে এয়োস্ত্রী মহিলারা সংসারের কল্যাণে এবং বিঘ্ননাশের উদ্দেশ্যে এই ব্রত করে থাকেন। ব্রতের নিয়মানুসারে সবকিছু তেরো সংখ্যায় নিবেদন করতে হয় দেবীকে। তেরোটি ফুল, তেরো রকম ফল, তেরো রকমের মিষ্টি ও তেরোটি পান-সুপুরি। সেইসঙ্গে তেরো গাছা লাল সুতো, তেরোটি দূর্বা সমেত তেরোটি গিঁট বেঁধে তৈরি করতে হয় হয় পবিত্র ধাগা। যা বিপত্তারিণী ব্রতের অন্যতম প্রধান উপকরণ। দেবী রক্তবর্ণা, চতুর্ভুজা ও ত্রিনয়না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অস্ত্রের পার্থক্য দেখা যায়। তবে প্রচলিত মূর্তিটিতে তাঁকে শঙ্খ-চক্র-শুল ও অসি হাতে দেখা যায়। আবার কোথাও তিনি ঘোর কৃষ্ণবর্ণা লোলজিহ্বা রূপে বাঘের ওপর আসীন। হাতে খড়গ, ত্রিশূল এবং বরাভয়। যদিও এই মূর্তি পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ কিছু মন্দিরেই দেখা যায়। স্বর্ণশোভিত দেবী সেখানে সারাবছর নিত্যপূজিতা। তবে বিপত্তারিণী ব্রতের ক্ষেত্রে বছরের নির্দিষ্ট দু-দিনেই পুজো পান দেবী। এই ব্রতের সঙ্গে মহাভারতের যোগও মেলে। শোনা যায়, মহাভারত যুদ্ধের পূর্বে পাণ্ডবদের বিপদ নাশের জন্য দ্রৌপদি আরাধনা করেছিলেন গৌরীর। পাণ্ডবদের রক্ষা এবং মঙ্গলকামনায় তিনি তাঁদের হাতে বেঁধে দিয়েছিলেন, তেরোটি গিঁট দেওয়া লাল ধাগা। দেবী গৌরি মাত্রেই মহামায়ার রূপ। তাই অনেকেই মনে করেন, দেবী বিপত্তারিণী পুজোয় তেরোটি গিঁট দেওয়া ধাগা বাঁধার প্রচলন সেখান থেকেই এসেছে।
আরও শুনুন: লাল হয় ব্রহ্মপুত্রের জল, অম্বুবাচীতে মহামায়ার যোনিপূজা ঘিরে আর কী রহস্য রয়েছে?
তবে বাংলায় দেবী মাহাত্ম্যের কাহিনি খানিক আলাদা। ব্রতের সম্পূর্ণ ফল মেলে সেই কাহিনি শোনার পরই। এয়োস্ত্রীরা বাড়িতে সমস্ত উপকরণ সাজিয়ে দেবীর পুজো করার পর এই কাহিনি বা ব্রতকথা শোনেন। সে কাহিনি খানিকটা এরকম,
আরও শুনুন: শুধুমাত্র জগন্নাথ নন, একই দিনে রথে চড়ে নগরভ্রমণে বেরোন মা তারাও
বাংলার বিষ্ণুপুরে সপ্তম থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত শাসন করেছিলেন মল্ল রাজারা। সেই বংশের এক রানি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ। তাঁর নিম্নবর্গীয় এক হিন্দু মহিলার সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল। রানী শুনেছিলেন, এরা যাতে মুচি। এরা এমন মাংস ভক্ষণ করে, যা সচরাচর তাঁরা খান না। একদিন তাঁর সখীকে বললেন, ‘একদিন তুমি একটু ওই মাংস রেঁধে আমাকে দিয়ে যাবে, আমি দেখব!’ রানীর এই প্রস্তাব শুনে সেই মুচিনী তো ভয়ে আধমরা। একেই সে নিচু জাতের রমণী। রানির সঙ্গে বন্ধুত্ব তার পরম পাওয়া। রাজ অন্তঃপুরে যদি সেই মাংস ঢোকে, আর এই কথা যদি ধর্মাচারী রাজার কানে যায়! তাহলে! শাস্তিস্বরূপ তার গর্দান যাবে অথবা রাজ্য থেকে বিতাড়িত হতে হবে। সেকথা সে রানীকে খুব করে বোঝাল। রানি একেবারেই নাছোড়বান্দা, তিনি তো চেখে দেখবেন না, খালি চোখে দেখবেন, এতে আর কীই বা দোষ হবে! রানির প্রবল জোরাজুরিতে খানিক ভরসা পেয়ে মুচিনী একদিন কথামতো মাংস রান্না করে সন্তর্পণে দিয়ে গেল রানিকে। কোনও কর্মী মারফত এই খবর পৌঁছয় রাজার কানে। অন্তঃপুরে সেই বিশেষ মাংস প্রবেশ করেছে। এই কথা শুনে রাজা তো অগ্নিশর্মা। উপস্থিত হলেন রানির কাছে। অন্দরমহলে পৌঁছে হুঙ্কার ছাড়লেন। বললেন, ‘কী নিষিদ্ধ বস্তু লুকিয়ে এনেছ! দেখাও আমাকে।’ রানি বুঝলেন সব হিসেব গোলমাল হয়ে গিয়েছে। তাঁর অতিরিক্ত কৌতূহল কাল হয়েছে। তিনি তাড়াতাড়ি রান্না করা মাংস আঁচলের তলায় লুকিয়ে দেবী দুর্গাকে এই বিপদ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আকুল-প্রার্থনা করতে লাগলেন। রাজা অনেকক্ষণ খুব জোরাজুরি করলেন কিন্তু রানি কিছুতেই আঁচলের তলায় কি আছে দেখাবেন না। রাজা ক্রোধে আগুন হয়ে, তাঁর আঁচল ধরে দিলেন হ্যাঁচকা টান। কী আশ্চর্য! সেখান থেকে তখন ঝরে পড়ল, রক্তজবা ফুল। অনুতপ্ত রাজা রানীর কাছে ক্ষমা চাইলেন। ভক্তপ্রাণা দেবী তখন আবির্ভূতা হয়ে রানিকে জানালেন, ‘আমি তোমাকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছি, এখন থেকে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, ভক্তিভরে আমার পূজা অর্চনা করো, আমিই তোমাদের সংসারের যাবতীয় বিপদ বাধা থেকে রক্ষা করব।’
আরও শুনুন: সাতদিনের জন্য মাসির বাড়ি থাকেন জগন্নাথ, কী বিশেষত্ব পুরীর গুন্ডিচা মন্দিরের?
সেই থেকেই মল্ল রাজাদের শাসনাধীন জনপদগুলোতে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে লাগল, বিপত্তারিণী মাহাত্ম্য। চালু হল, খুব নিষ্ঠা সহকারে তাঁর পূজা। এইভাবেই বঙ্গ-কলিঙ্গের ঘরে ঘরে এয়োস্ত্রীদের যাবতীয় বিপদ-আপদ থেকে মুক্তির জন্য সহায় হয়ে আছেন দেবী বিপত্তারিণী চণ্ডী। সবক্ষেত্রে মন্দিরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বাড়িতেই নিষ্ঠাভরে দেবীর পুজো করা সম্ভব। নির্দিষ্ট ১৩ রকমের সামগ্রীর উপকরণ যোগাড় করে ভক্তিভরে পুজো করলেই ফল মেলে। আর সবশেষে শুনতে হয় দেবীর ব্রতকথা। তাহলেই তিনি ভক্তদের বিঘ্ননাশনে সদা জাগ্রত থাকেন। ভক্তের বিপদ বাঁধা দূর হয়, পূর্ণ হয় সকল মনোবাঞ্ছা।