১৯৮৩ সালের ২৫ জুন। বিশ্বমঞ্চে ভারতীয় ক্রিকেটের জয়যাত্রার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেদিনই। তারপর কেটে গিয়েছে চারটে দশক। সময় বদলে গিয়েছে, পালটে গিয়েছে দেশের মন আর মানুষ। তবু আজও যেন দেশবাসী বুকের গভীরে কান পেতে শুনতে পায় শত ঝরনার জলোচ্ছ্বাস। ২৫ জুন আধুনিক পৃথিবীতে নতুন ভারতবর্ষের মাথা তুলে দাঁড়ানোর দিন। আর সেই দিনটার কাণ্ডারি আর কেউ নন কপিল দেব নিখাঞ্জ। ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞ বোরিয়া মজুমদারের মুখোমুখি হয়ে সেদিনের সেই মুহূর্তের স্মৃতিতে ডুব দিলেন স্বয়ং বিশ্বজয়ী অধিনায়ক।
প্র: শুনেছি সেই ঐতিহাসিক ফাইনালের সকালে আপনি নাকি চুপিচুপি এক বোতল শ্যাম্পেন সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিলেন। সত্যি নাকি?
কপিল: হ্যাঁ সে-কথা তো এখন পাঁচকান হয়েই গিয়েছে। আসলে প্রুডেনশিয়াল কাপে আমরা যে-পর্যায়ের ক্রিকেট খেলছিলাম, তাতে আমাদের ফাইনাল জেতার সম্ভাবনা নিয়ে আমি অনেকখানি নিশ্চিতই ছিলাম। সঙ্গে তাই শ্যাম্পেনের বোতল রেখেছিলাম। সেদিন খেলাটা যখন শেষ হল, আমি ওয়েস্ট ইন্ডিজের ড্রেসিংরুমে গিয়েছিলাম ক্লাইভ লয়েডের সঙ্গে কথা বলতে। সেখানে তখন দৃশ্যতই হতাশার ছবি। যা ঘটে গেছে কেউই যেন তা বিশ্বাস করে উঠতে পারছিল না। দেখলাম শ্যাম্পেনের কার্টুনটা একদিকে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমার মনে আছে, আমি ক্লাইভকে বলেছিলাম যে, এগুলো তো এখানে আর কোনও কাজে লাগবে না। তোমার ছেলেদের আপাতত আর শ্যাম্পেন দরকার হবে না। এগুলো বরং আমাদের ড্রেসিংরুমে নিয়ে গেলেই কাজের কাজ হবে। ক্লাইভ তাতে সায় দিয়েছিল। আমি খান চারেক বোতল নিয়ে চলে এসেছিলাম। আপনারা সেদিনের সেলিব্রেশনের ছবিগুলোতে ওই শ্যাম্পেনের বোতলগুলিই দেখেন।
আরও শুনুন: ১৯৮৩-র জয় শুধু ক্রিকেটের নয়! সাদা-কালো অবয়ব থেকে শুরু রঙিন ইন্ডিয়ার জয়যাত্রা
প্র: সেই সময়ের ওয়েস্ট ইন্ডিজের যে ব্যাটিং লাইন-আপ, সেখানে ১৮৩ তো এমন আহামরি রান নয়। তার পরেও জেতা যে সম্ভব, তা ম্যাচের ঠিক কোন বিন্দুতে পৌঁছে বুঝতে পারলেন?
কপিল: ১৮৩ তাড়া করা কোনও ব্যাপারই নয়, আমি কিন্তু এমনটা ভাবিনি। আমি সবসময় ব্যাপারটা উলটো দিক থেকে দেখছিলাম। যে, আমাদের হাতে ১৮৩ রান আছে। আর যদি ওদের জিততে হয়, তাহলে এই রানটা করতে হবে। আমি ছেলেদের বলেছিলাম, মাঠে শুধু আমাদের সেরাটা তুলে ধরতে হবে। বোলিং আর ফিল্ডিংটা ঠিকঠাক করতে হবে। আগামী ৩ ঘণ্টা আমাদের ইতিহাস গড়ার জন্যই খেলতে হবে। আর সকলেই সেই মুহূর্তে চাইছিল, ম্যাচটা জেতার ক্ষেত্রে যেন তারও কিছু অবদান থাকে। চাইছিল, কিছু করে দেখিয়ে নিজের ভূমিকা স্মরণীয় করে রাখতে। চতুর্থ উইকেট পড়তেই আমরা জয়ের গন্ধটা পেয়ে গেলাম। বুঝলাম দোর্দণ্ডপ্রতাপ ওয়েস্ট ইন্ডিজ চাপে পড়ে গিয়েছে। আমরা একটা করে উইকেট পেতে লাগলাম। আর ওদের উপর চাপের পাহাড় তত ভারী হতে লাগল।
প্র: শুনেছি, ফাইনাল ম্যাচ জিতে ড্রেসিংরুমে ফিরে আপনি নাকি এক বোতল দুধ খেয়েছিলেন!
কপিল: হ্যাঁ, খেয়েছিলাম তো। এত খিদে পেয়েছিল যে কী বলব! আর ওখানকার দুধটাও বেশ অন্যরকম ছিল। তবে তার মানে এই নয় যে, পরে আমি শ্যাম্পেন মুখে তুলিনি।
আরও শুনুন: ১৯৮৩ সালের ২৫ জুন ভারতের ক্রিকেট জেগে উঠেছিল এক নতুন দিনের ভোরে
প্র: এই প্রশ্নটা আপনি হয়তো বহুবার শুনেছেন, তবু পুনরায় করার লোভ সংবরণ করা যাচ্ছে না। ভিভ রিচার্ডসের ক্যাচটা ধরার জন্য যখন আপনি দৌড়চ্ছিলেন, তখন আপনার মনে ঠিক কী ভাবনা খেলা করছিল?
কপিল: সত্যি বলতে মনে কিছুই ছিল না। ভাবনা-টাবনার কোনও জায়গাই ছিল না তখন, যাকে বলে শূন্য, পুরো ব্ল্যাঙ্ক। আসলে যখন কেউ ক্যাচ ধরতে দৌড়ায় তখন মনে হাবিজাবি সব ভাবনারা জট পাকিয়ে গেলেই মুশকিল। তখন একমাত্র বলটা তালুবন্দি করার দিকেই নজর রাখতে হয়। আমিও তা-ই করেছিলাম। আর ক্যাচটা যে ধরতে পেরেছিলাম, তাতে আমি আনন্দিত। সেটা খেলার এমন একটা মুহূর্ত, যেখান থেকে খেলার ভরকেন্দ্র অনেকখানি আমাদের দিকে ঘুরে গেল। আমাদের জয়ের দরজাটা যেন আরও একটু খুলে গেল।
প্র: জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে আপনার ব্যাট থেকে আসা সেই ১৭৫-এর ইনিংসই কি ২৫ জুন, ১৯৮৩-র সুর বেঁধে দিয়েছিল?
কপিল: জিম্বাবোয়ে ম্যাচের পর দল হিসাবে আমরা বুঝেছিলাম যে, আমরা যে কোনও পরিস্থিতিতে বিশ্বের যে কোনও দলের বিরুদ্ধে জিততে পারি। ১৭-৫ থেকে যদি ম্যাচ জেতা সম্ভব হয়, তাহলে আর যে কোনও খারাপ পরিস্থিতি থেকে জেতা যাবে না কেন! দলের আত্মবিশ্বাস যখন এই পর্যায়ে থাকে, তখন আর আলাদা করে অধিনায়কের কিছু করার থাকে না। সকলেই একটা ছন্দে চলছে যেন। প্র্যাকটিসে আরও একটু বেশি খাটছে, ম্যাচে নিজেকে নিংড়ে দেওয়ার জন্য। নিজেদের প্রতি বিশ্বাসটাই অন্য মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছিল। আর খেলাটা তো হয়েওছিল সেরকম। আমার ছ-সাত নম্বরে নামার কথা। টপ অর্ডার খেলছে দেখে আমি তো স্নান করতে চলে গিয়েছিলাম। ওই ঠান্ডায় গরম জলে স্নান করে একটু আরাম পাব ভাবছি, অমনি কে যেন এসে বলল, আমাকে ব্যাট করতে যেতে হবে। আমি গিয়ে নন স্ট্রাইকার এন্ডে যে ছিল তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কী পরিস্থিতি? সে বলল, কোনও ধারণাই নেই। আমাদের ব্যাটসম্যানদের কেউই নাকি পরাস্ত হয়নি। সকলেই বলে খোঁচা দিয়ে আউট হয়েছে। অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছিল সেদিন। সব মিলিয়ে গোটা দিনটাই ছিল যেমন অদ্ভুত তেমন ব্যতিক্রমী আর চমৎকার।