রথযাত্রা ভারতের প্রাচীন উৎসব। শুধুমাত্র হিন্দু নয়। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও রথযাত্রার প্রচলন রয়েছে। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে সে উল্লেখ মেলে। তবে গোটা পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে বড় রথযাত্রা পালিত হয় পুরীতে। মহাপ্রভু জগন্নাথের রথ। আলাদা তিনটি রথে নগর পরিক্রমায় বেরোন ত্রিমূর্তি। সেইসঙ্গে রথে আসীন হন আরও অনেক দেবদেবী। কী বিশেষত্ব ওই তিন রথের? আসুন শুনে নিই।
‘জগন্নাথঃস্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে’
রথে আসীন প্রভু জগন্নাথ। গণধর্মের গণদেবতা এগিয়ে চলেছেন গুণ্ডিচা মন্দিরের উদ্দেশে। কথিত আছে, রথে বসে বহুদূর পর্যন্ত ভগবান দৃষ্টি দেন। আর সেই আশীর্বাদী দৃষ্টি ছুঁয়ে যায় ভক্তকে। সে চোখের সৌন্দর্য এমনই, ভক্ত যেখান থেকেই দেখুন না কেন, জগন্নাথকে দেখা যাবেই। তাই রথ উপলক্ষ্যে লক্ষ মানুষ ছুটে আসেন শ্রীধামে।
আরও শুনুন: নীল বর্ণের জগন্নাথ, মহিলারাও অংশ নেন প্রভুর এই বিশেষ রূপের পুজোয়
এতবড় আয়োজনের প্রস্তুতি পর্বও যে ব্যাপক হবে, তা বলাই বাহুল্য। জানা যায়, পুরীতে রথের প্রস্তুতি শুরু হয় পাঁচ মাস আগে থেকে। মাঘ মাসের বসন্ত পঞ্চমীতে কাঠ সংগ্রহ দিয়ে শুরু হয় সেই কাজ। রথ তৈরি শুরু হয় অক্ষয় তৃতীয়ার দিন থেকে। জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার জন্য তিনটি আলাদা রথ। সবকটির উচ্চতা ও চাকার মাপ আলাদা। রথগুলোর মাঝ বরাবর তৈরি হয় মণ্ডপ ও বেদি। আর সেখানেই অবস্থান করেন মহাপ্রভু। মণ্ডপের চারদিকে থাকে চারটি তোরণ। বিভিন্ন রঙিন ছবি, অলংকার ও পুতুল দিয়ে সজ্জিত থাকে তিনটি রথ। পট্টবস্ত্র দিয়ে সাজানো হয় রথগুলো। আর সবকটির উপরই থাকে ধ্বজা।
আরও শুনুন: শ্রীমন্দিরে অপূর্ব লীলা, জগন্নাথের সঙ্গে কেন থাকেন দেবী বিমলা?
পুরুষোত্তম মাহাত্ম্যের বর্ণনা অনুযায়ী, জগন্নাথদেবের রথের নাম ‘নন্দীঘোষ’। রথের ধ্বজায় চক্র এবং গরুড়ের চিত্র বর্তমান। রথের উচ্চতা প্রায় পঁয়তাল্লিশ ফুট। চাকার সংখ্যা ষোলো। মনে করা হয়, এই ষোলো চাকা আসলে, দশ ইন্দ্রিয় এবং ছয় রিপুর কথা বলে। রথের রং লাল-হলুদ। জগন্নাথের রথে রক্ষক হিসেবে থাকে নৃসিংহদেব। রথের সারথি মিতালি। চারটি সাদা রঙের ঘোড়া রথের সঙ্গে জোড়া। এঁরা হলেন, রোচিকা, মোচিকা, সূক্ষ্মা এবং অমৃতা। তবে এই রথে জগন্নাথ ছাড়াও যে দেবতারা আসীন হন তাঁরা হলেন, বরাহ, গোবর্ধন, কৃষ্ণ, গোপীকৃষ্ণ, নৃসিংহ, রাম, নারায়ণ, বিক্রম, হনুমান ও রুদ্র। এছাড়া ধ্বজায় থাকেন দ্বারপাল।
আরও শুনুন: রথযাত্রায় জগন্নাথ যান গুণ্ডিচায়, সে সময় কি শূন্য থাকে শ্রীমন্দির?
এরপর আসা যাক শ্রী বলরামের রথ বর্ণনায়। বলভদ্রের রথের নাম তালধ্বজ। ধ্বজার মধ্যেই তাল এবং লাঙল দেখা যায়। এই রথের উচ্চতা প্রায় চুয়াল্লিশ ফুট। চাকার সংখ্যা চোদ্দো। অনেকেই এর সঙ্গে চোদ্দো ভুবনের মিল খুঁজে পান। রথের রং লাল-সবুজ। রথের রক্ষক শেষাবতার। সারথি হিসেবে থাকেন সদ্যুম্ন। বাদামি রঙের যে চারটি ঘোড়া রথে সঙ্গে যুক্ত তাঁরা হলেন, স্থিবা, ধৃতি, স্থিতি ও সিদ্ধা। এই রথের পার্শ্বস্থ দেবতারা হলেন, গণেশ, কার্তিক, সর্বমঙ্গলা, হলায়ুধ, শেষদেব, মহেশ্বর প্রমুখ।
আরও শুনুন: স্বয়ং বুদ্ধই কি নতুন রূপে এলেন প্রভু জগন্নাথ হয়ে! কী ব্যাখ্যা শাস্ত্রের?
অন্যদিকে শ্রী সুভদ্রার রথের নাম ‘পদ্মধ্বজ’। এর উচ্চতা প্রায় তেতাল্লিশ ফুট। রাজপথে তিনটি রথ পাশাপাশি এগোয়। এক্ষেত্রে দেবী সুভদ্রার রথটি থাকে ঠিক মাঝখানে। ধ্বজার মধ্যে পদ্মচীহ্ন উপস্থিত। চাকার সংখ্যা ১২। মনে করা হয়, এই বারোটি চাকা আসলে বারো মাসকে নির্দেশ করে। রথের রং লাল-কালো। রক্ষক হিসেবে থাকেন বনদুর্গা। এবং রথের সারথী স্বয়ং অর্জুন। এখানেও চারটি ঘোড়া। তাঁরা হলেন, অধর্ম, অজ্ঞান, অপরাজিত এবং জ্যোতিষী। রথে দেবী সুভদ্রা ছাড়াও অবস্থান করেন, দেবী চণ্ডী, চামুণ্ডা, বিমলা, মঙ্গলা, বারাহী ও শ্যামাকালী। শোনা যায় রথের রশিতে টান দেওয়ার জন্য কোনও জাতপাতের বাধন থাকে না। তাই রথ উপলক্ষে যে ভক্তিপ্লাবনে ভাসে পুরীধাম, তার তুলনা মেলা ভার।