বিগ বেন, বাকিংহাম প্যালেস, লন্ডন আই থেকে বেকার স্ট্রিট। রাজার দেশের যেমন রাজকীয় মেজাজ তেমনই নয়নাভিরাম দৃশ্য। সেখানেই বসেছিল বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের আসর। পেশার কারণে রাজভূমে পা রেখে নেশার টানে লন্ডনের অলিগলিও ঘুরে দেখলেন রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়। সেই ‘বিলেতযাত্রীর নোটবুক’ থাকল সংবাদ প্রতিদিন শোনো-য়।
এখানে একটা কসাইখানা থাকার কথা। আর একটা আচার কারখানা। কোথায়, কোথাও কিছু নেই তো! বদলে নিঃসঙ্গ স্টুডিও দেখছি, নিঝুম কেমন দাঁড়িয়ে। দরজা বন্ধ, জানালা সাঁটা। আচ্ছা, স্টুডিও মালিক জানেন, তাঁর দোকানের পাশে এককালে থাকতেন কালজয়ী সিনেমাওয়ালা?
ওখানে এত আগাছার অবিন্যস্ত গুল্ম কেন? জায়গাটা তকতকে থাকা উচিত। কত ভালবেসে বেঁটেখাটো, বাটারফ্লাই গোঁফের পড়শিরা বাড়ি সংলগ্ন অঞ্চলে বাগান করেছিল, নাম রেখেছিল ‘চার্লি’স প্যাচ’। দৈন্যের শৈশবের বছরখানেক তো কেটেছিল এ বাড়িতে, যেখানে মা হানা আর সহোদর সিডনির সঙ্গে এসে উঠেছিলেন খুদে চার্লি। আজ আর সেই প্যাচ-ট্যাচ নেই। রাশি রাশি অবহেলার সাদা ফুল জন্মেছে বরং আলগোছে। চারদিকে। বিস্মৃত ইতিহাসকে হৃদয়ে নিয়ে।
আরও শুনুন: বিলেতযাত্রীর NOTEBOOK: সুন্দরী প্যারিসকে যেন কটাক্ষ হানে রাজার দেশের ‘লন্ডন আই’
আচ্ছা, ওই গাঢ় বাদামি ডেস্ক কি সওয়া একশো বছর আগেও ছিল? মাঝে মাঝে ওখানে কি এসে বসতেন ক্ষণজন্মা, অলস দুপুরের অবসরে? জানালার ফাঁক দিয়ে আজ যেখানে দেখা যায়, পেল্লায় হেডফোন কাত হয়ে শুয়ে, কিছু বইপত্র ছড়ানো-ছেটানো। কে জানে, ইতিহাস তো বলে জায়গাটা আগে লজ ছিল। যেখানে বছরখানেকের মেয়াদে পরিবারের সঙ্গে এসে উঠেছিলেন তিনি।
লন্ডনের ৩৯ মেথলি স্ট্রিটের মুখোমুখি দাঁড়ালে বঙ্গহৃদয় কেমন শিরশির করে। আবেগে-স্মৃতিতে ঘোলাটে হয়ে আসে সব কিছু। এই ইট-ইট, ফ্যাকাশে হলুদ বাড়িতেই শতাধিক বছর আগে কিনা থাকতেন তিনি! শৈশবের সাদা-কালো টিভিতে যার নির্বাক অথচ অসীম কৌতুক দেখে পেটে খিল ধরে যেত!
চ্যাপলিন, এটা চার্লি চ্যাপলিনের বাড়ি!
এটাই পৃথিবীর গ্রেটেস্ট শোম্যানের বাড়ি!
লন্ডনের কেনিংটনে চ্যাপলিনের একটা নয়, দুটো বাড়ি রয়েছে। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল কভার করতে এসে দুটোতেই গিয়েছিলাম। আধঘণ্টা হাঁটাপথ ব্যবধানের দুটো বাড়ি। ১৫, গ্লেনশ ম্যানসনের বাড়িটা খুঁজে পেতে একটু অসুবিধেই হবে। গুগল ম্যাপ তো আর আকাঙ্ক্ষার দরজা-খিলান পর্যন্ত সব সময় নিয়ে যাবে না। ‘সিটি লাইটস’, ‘দ্য গ্রেট ডিক্টৈটর’ খ্যাত মহাভিনেতার বয়স বছর বাইশ যখন, গ্লেনশ ম্যানসনসে এসে দু’বছর ছিলেন তিনি। নিচে দেখলাম, একটা সুপার মার্কেট হয়েছে। তার ভারতীয় দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করেই জানতে পারা গেল যে, পাশের একফালি দরজা ঠেলে ঢুকলে চার্লির বাড়ি। পনেরো নম্বর ফ্ল্যাট। তবে ঢোকায় নিষেধাজ্ঞা আছে। অচেনা-অজানারা উৎপাত করলে বাসিন্দারা বেজায় রুষ্ট হন। ঘুলঘুলির গায়ের ‘প্লেক’ ভাল করে পড়াও যায় না। গাছের পাতার শান্ত শীতল ছায়ায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে লেখাটা- ‘অ্যাক্টর অ্যান্ড ফিল্মমেকার লিভড হিয়ার বিটুইন ১৯০৮-১৯১০’। ডান দিকে ঘুরলেই প্রখ্যাত ব্রিটিশ অভিনেতা ম্যাক্স ওয়ালের বাড়ি। লাগোয়া ফুটফুটে কিশোরীর মতো একটা কাফে, ভ্যান গঘের নামে। কিন্তু এ চত্বরে চ্যাপলিন নামক অনুভূতিকে ছোঁয়া যায় না তেমন। যতটা যায়, ৩৯ মেথলি স্ট্রিটের বাড়িতে।
আরও শুনুন: বিলেতযাত্রীর NOTEBOOK: হে গজরাজ! তুমি যে বিলেতে কে তা জানত!
তিনটে পাশাপাশি ফ্ল্যাট যে বাড়িতে, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ইতিহাসকে বহন করে যারা, যার সাদা জানালাকে আষ্টেপৃষ্ঠে উঠে গিয়েছে কিছু বেগুনি ফুল। যে বাড়ির লাল দেওয়ালে ‘ডেড কমিক সোসাইটি’-র লোকজন লিখে দিয়ে গিয়েছে ‘ফিল্মমেকার এবং ওয়াটার র্যাট ১৮৯৮-‘৯৯ পর্যন্ত ছিলেন এখানে’। যে বাড়ির একলা বেতের চেয়ার, ধোঁয়া ছেড়ে-ছেড়ে ক্লান্ত চিমনি, ঘুমিয়ে থাকা ‘ডোরম্যাট’, গম্ভীর কালো দরজা ফিরিয়ে নিয়ে যায় একশো বছর পিছনে, কোনও এক অজানা টাইম মেশিন চাপিয়ে, দাঁড় করিয়ে দেয় সেই খর্বকায় অবয়বের সামনে, আলাপ করিয়ে দেয় তার চেতনার সঙ্গে।
যে অসম্ভবকে ভালবাসত, যে মানবজাতিকে মাটির দিকে চেয়ে নয়, আকাশে তাকিয়ে স্বপ্নের রামধনু দেখতে শিখিয়েছিল!