রাজপথে নেমেছেন প্রভু। রথে আসীন ত্রিমূর্তি এগিয়ে চলেছেন গুণ্ডিচা মন্দিরের উদ্দেশে। চারদিক লোকে লোকারণ্য। সাতদিন প্রভু সেখানেই থাকবেন। কিন্তু এই ক-দিন শ্রীমন্দিরের কী হবে? রত্নবেদী প্রভুশূন্য হওয়া তো অসম্ভব! সেখানেই প্রকাশ পায় দেব জগন্নাথের আরেক লীলা। রত্নবেদীতে শুধুমাত্র ত্রিমূর্তি নন, বিরাজ করেন আরও চার দেববিগ্রহ। আসুন শুনে নিই, রত্ন সিংহাসনে সপ্ত বিগ্রহের কথা।
শ্রীমন্দিরে মূলত জগন্নাথের টানেই দূরদুরান্ত থেকে ছুটে আসেন ভক্তরা। সারা বছর ভক্তদের আশীর্বাদ করেন রত্নবেদীতে অধিষ্ঠিত ত্রি-মূর্তি। কিন্তু রথের সময় প্রভুর ঠিকানা হয় অন্য এক মন্দির। এদিকে রত্নবেদী কখনই খালি থাকা সম্ভব নয়। আদতে তা থাকেও না। এইসময় শ্রীমাধব জগন্নাথের পরিপূরক হিসেবে মন্দিরে বিদ্যমান থেকে গৃহকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। এই শ্রীমাধবই হলেন সপ্ত বিগ্রহের অন্যতম।
আরও শুনুন: রথযাত্রার আনন্দে মাতবে গোটা দেশ, কীভাবে সূচনা হয়েছিল এই উৎসবের?
শ্রীবলভদ্র, দেবী সুভদ্রা, শ্রীজগন্নাথের সঙ্গেই শ্রীসুদর্শন, শ্রীদেবী, ভূ-দেবী ও শ্রীমাধব, এই সপ্তমূর্তি শ্রীমন্দিরের রত্নসিংহাসনে বিরাজমান। জগন্নাথ-বলভদ্র ও সুভদ্রা একত্রে ত্রিমূর্তি। যাঁরা জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ ও কর্মযোগের প্রতীক। বলভদ্র শিবের স্বরূপ, সুভদ্রা ব্রহ্মা এবং জগন্নাথ শ্রী-বিষ্ণুর। আবার আদি শঙ্করাচার্য সুভদ্রার সঙ্গে আদ্যাশক্তি মহামায়ার মিল উল্লেখ করেছেন। সুতরাং এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ত্রিমূর্তির মধ্যেই শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব মতের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে, সুদর্শন বেদের স্বরূপ। শ্রীদেবী সুবর্ণপ্রতিমা, লক্ষ্মীস্বরূপা, জগৎ-জননী। ভূদেবী রৌপ্য প্রতিমা, বিশ্বধাত্রী তথা বিষ্ণুর অন্যতম শক্তিস্বরূপিনী। এবং সবশেষে যাঁর প্রসঙ্গ উল্লেখ না করলেই নয়, তিনি শ্রী মাধব। মূলত কাষ্ঠবিগ্রহ। শ্রীজগন্নাথের পিছনে বাঁদিকে অবস্থান করেন তিনি। আদতে জগন্নাথেরই ক্ষুদ্র প্রতিরূপ এই শ্রীমাধব। সারাবছর গর্ভমন্দিরের প্রবেশদ্বারেই জগন্নাথের দর্শন পান ভক্তরা। কিন্তু শ্রীমাধবকে ওই অবস্থান থেকে লক্ষ্য করা অসম্ভব। কেবল রথযাত্রার সময় তিনি জগন্নাথের স্থানে একাকী বিরাজ করেন। এ ছাড়া মহাপ্রভুর স্নানাদির সময়, তড়প , উত্তরীয় লাগি- ইত্যাদি বিভিন্ন পূজা কর্মসূচিতে এই ক্ষুদ্র প্রতিমা লোকসমক্ষে দৃশ্যমান হন। দুর্গাপুজোর সময়ও তাঁকে বিশেষ ভূমিকায় দেখা যায়। এই সময় শ্রীমাধব বিমলা মন্দিরে মা কনকদুর্গার সঙ্গে দুর্গামাধব রূপে পূজিত হন। তবে রত্নসিংহাসিনে অধিষ্ঠিত হওয়ার তাৎপর্য শ্রী জগন্নাথের পরিপূরক হিসেবে মন্দিরের দায়িত্বভার গ্রহণ করা। তাঁর কারণেই শ্রীমন্দির কখনও প্রভুশূন্য থাকে না।
আরও শুনুন: এইসব দেবতার মূর্তি রেখেছেন ঠাকুরঘরে? হতে পারে মারাত্মক বিপদ
শ্রীমন্দিরের রত্ন সিংহাসনের গুরুত্বও নেহাতই কম নয়। শাস্ত্রমতে এই বেদী পবিত্রতম। সিংহাসনে দু-ফুট উঁচু তিনটি পাথরের পিণ্ড রয়েছে, যার উপর ত্রিমূর্তি বিরাজমান। মনে করা হয়, এই পিণ্ডর নীচে এক লক্ষ জীবন্ত শালগ্রাম শিলা রয়েছে। তাই সেবকরা অত্যন্ত নিষ্ঠাভরে রত্নবেদী স্পর্শ করেন। পূজাও হয় অত্যন্ত সন্তর্পণে। বৈষ্ণব তত্ত্বে এই রত্নবেদীকে মণি বৈকুন্ঠ হিসাবে দেখা হয়। এখানে আত্মতত্ত্বস্বরূপ বলভদ্র, বিদ্যাতত্ত্বস্বরূপা সুভদ্রা এবং পরমত্ত্বস্বরূপ শ্রী জগন্নাথ বিরাজ করেন। আবার মহাতত্ত্ব সুদর্শন, সত্যতত্ত্ব মাধব, নির্গুণতত্ত্ব ভূদেবী এবং তুরীয়তত্ত্ব জ্ঞানে শ্রীদেবী পূজিতা হন। এঁদের কৃপায় ধন্য হয় মানবজাতি। আর অগণিত ভক্ত ছুটে আসেন পুরুষোত্তম লীলাক্ষেত্র পুরীধামে।