স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নাকি খেতে হবে হাজার বছরের পুরনো ডিম! অন্তত আমন্ত্রিত ভোজসভার মেনু সে কথাই জানান দিচ্ছে। না খেলে, যিনি খেতে দিয়েছেন তাঁর অসম্মান। আর খেলে তো… বুঝতেই পারছেন! তা, এমন বিষম সংকট রবীন্দ্রনাথ কীভাবে ম্যানেজ করলেন জানেন! সে-কথাই শোনাচ্ছেন, সৌভিক সরকার।
সেবার চিন ভ্রমণে গিয়েছেনরবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে আছেন বেশ কয়েকজন জ্ঞানীগুণী মানুষ।তো কবির সম্মানে সেখানে আয়োজন করা হয়েছে এক ভোজসভা। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে নেমন্তন্ন করা হয়েছে আর সে দেশের স্পেশাল খাবারটি দেওয়া হবে না, তা কি কখনও হয়! তা খাবারের মেনুতে চোখ পড়তেই অনেকেরই হাল বেহাল। কেননা সেখান থেকে তখন উঁকি দিচ্ছে, ‘হাজার বছরের পুরোনো ডিম’।
ঘটনাটা খেয়াল করলেন স্বয়ং কবিও। এমনিতে খাবার নিয়ে তাঁর তেমন বাছবিচার নেই। নিত্যনতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা পছন্দই করতেন। সেই পরীক্ষার ফলেই কখনও প্লেটে উঠত মানকচুর জিলিপি,তো কখনও খেতেন দইয়ের মালপোয়া।রান্না করা খাবার ছাড়াও,কাঁচা ডিম কি কাঁচা সবজি – এসবও খেতে পারতেন অম্লান বদনে। এমনকী নিমপাতার থকথকে রস-ও খেয়ে নিতেন সোনামুখ করে।তবু, যিনি লিখেছিলেন ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান’,নানারকম খাবারখাওয়ার রীতি নিয়ে যে তাঁকেও বিপাকে পড়তে হবে, একথা বোধহয় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ভেবে উঠতে পারেননি।খাবার বলে খাবার! মেনু তো বলছে, খেতে হবে‘হাজার বছরের পুরোনো ডিম’! সে কি চাট্টিখানি কথা! নাকি এ জিনিস খাওয়ার পর পর শরীর সুস্থ থাকবে!
কবির সঙ্গীরা যারপরনাই চিন্তিত। কবিও হয়তো চিন্তিত, কিন্তু মুখে প্রকাশ করার মানুষ তো তিনি নন। আপনারাও নিশ্চয় চিন্তায় পড়েছেন। ব্যাপারটা কী? গল্পটাতাহলে খোলসা করেই বলা যাক। ভয়পাবেন না,ডিমগুলো সত্যি সত্যি হাজার বছরের পুরনো নয়। তবে হ্যাঁ, বহুদিনের পুরনো তো বটেই। যে রেসিপির কথা মেনুতে লেখা ছিল, সেটি ছিল অন্তত হাজার বছরের পুরনো। চিনে এই খাবার নাকি অত্যন্ত উপাদেয়, এবং সম্মাননীয় অতিথিদের তো তা দেওয়া হয়ই হয়।কোনওএক চিনা মিস্ত্রি নাকি একসময় বাড়ি বানাতে গিয়ে মাটির নিচে চাপা পড়া বেশ কয়েকটা ডিম উদ্ধার করেন। আশ্চর্য ব্যাপার, ডিমগুলো ছিল পুরোপুরি অক্ষত। ভদ্রলোক খেয়ে দেখলেন, মন্দ খেতে লাগছে না! বলা হয়, সেই নাম না-জানা মানুষটিই এই ডিম সংরক্ষণের পদ্ধতি শুরু করেছিলেন।
সংরক্ষণ করার জন্য ডিমগুলোকেকাদা মাখিয়ে রেখে দেওয়া হত একশো দিন।কেউ কেউ বলেন, মাটির সঙ্গে নুন মিশিয়েও দেওয়া হত।যতক্ষণ না ডিমের সাদা অংশ কালচে বেগুনি রংধরে, ততক্ষণ ডিমগুলো মাটির তলাতেই থাকত। কেবল চিন নয়, বর্মা, জাপান, হংকং-এর রাস্তায় স্ট্রিট ফুড হিসেবে কদর রয়েছে এই ডিমের। তা ছাড়া অনুষ্ঠানের ভোজে এই আইটেমটি থাকবেই।সুতরাংরবীন্দ্রনাথের সম্মানে আয়োজিত ভোজসভাতেও অবধারিত ভাবে জায়গা পেয়েছিল এই ডিম, আর পদটির নাম ছিল হাজার বছরের পুরনো ডিমের রান্না।
ভাবছেনতো, এতে আর সমস্যা কোথায়? সমস্যা হল যে, সেই চৈনিক ডিম খেয়ে গুরুদেবেরসঙ্গী নন্দলাল বসু আর ক্ষিতিমোহন সেন-এর অবস্থা কাহিল! আসলে এতদিন রেখে দেওয়ারফলেডিমের প্রোটিনের একটা অংশ অ্যামোনিয়ায় পরিণত হয়।বুঝতেই পারছেন, মুখে ডিম তুললেই নাকে ভেসে আসবে উৎকট গন্ধ। অনেকের আবার ধারণা ছিল যে, এই ডিম তিন মাস ঘোড়ার মূত্রের জালায় ডুবিয়ে রাখা হয়। থাইল্যান্ডে তো এর নামই তো তাই -‘থাই ইউ মা’, অর্থাৎ, ঘোড়ার মূত্রে চোবানো ডিম।
এখন, হাজার বছরের পুরনো হোক আর একশো দিনের, এমন ডিম খাওয়া মুখের কথা নয়! কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কি এই ডিম সত্যিই খেয়েছিলেন? উপস্থিত কেউ কেউ বলে থাকেন, খাওয়ার ছলে ডিমটিকে নাকি জোব্বার ভিতর চালান করেছিলেন তিনি।
সাধে কি আর তিনি গুরুদেব!