বিগ বেন, বাকিংহাম প্যালেস, লন্ডন আই থেকে বেকার স্ট্রিট। রাজার দেশের যেমন রাজকীয় মেজাজ তেমনই নয়নাভিরাম দৃশ্য। সেখানেই বসেছে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের আসর। পেশার কারণে রাজভূমে পা রেখে নেশার টানে লন্ডনের অলিগলিও ঘুরে দেখলেন রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়। সেই ‘বিলেতযাত্রীর নোটবুক’ থাকল সংবাদ প্রতিদিন শোনো-য়।
হাতিটা বড্ড নাদুসনুদুস, আত্মভোলা। মুলোর মতো দাঁত, কুলোর মতো কান। সবুজ গাছ-গাছালির মাঝে কেমন গোবেচারা দাঁড়িয়ে আছে! শুধু নড়ন নেই, চড়ন নেই, দেহে আসলে প্রাণ নেই। রক্তমাংসের নয়, ও যে খড়কুটোর!
নিরীহ। নিথর। নির্বিকার।
ভারতবর্ষে গজরাজকে পুজো করা হয় ঈশ্বর জ্ঞানে। লোকে চেনে সিদ্ধাদাতা রূপে, সাক্ষাৎ বাণিজ্য দেবতা যিনি। কে জানত, বিলেতেও কোথাও কোথাও হয় তা। অবিশ্বাস্য শোনালে না হয় লন্ডন ঘুরতে এলে আসুন দক্ষিণে, ওভাল থেকে দু’টো টিউব স্টেশন দূরত্বের এলিফ্যান্ট অ্যান্ড ক্যাসল-এ।
১১ একর জমিকে মূলধন করে কী করে একটা জায়গার জেল্লা সম্পূর্ণ বদলে ফেলা যায়, তা চাক্ষুষ না করলে বিশ্বাস হত না। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল কভার করতে এসে যা নিত্য দেখছি, অনুভব করছি। কী নেই এই ১১ একর জমিতে! সহস্র বাড়ি, অজস্র বার-পাব-রেস্তোঁরা-ফুড মার্কেট। অফুরান গাছ-গাছালি। আর এই সব কিছুর, যাবতীয় বিত্তের বিমূর্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওই খড়ের ঐরাবত– এলিফ্যান্ট অ্যান্ড ক্যাসলের আত্মা ও প্রাণশক্তির প্রতিভূ হয়ে।
টেস্ট ফাইনাল কভার করতে এসে আমাদের অস্থায়ী নিবাস যেখানে, নাম তার ৪৬ চ্যাথাম স্ট্রিট। যে গলির সদরদরজায় অতন্দ্র প্রহরীর মতো দিন-রাত্তির দাঁড়িয়ে এক বিশাল গির্জা। আর গলিতে একবার ঢুকলে চোখ পুরো জুড়িয়ে যায়। বাড়ি-ঘর-দোর সমস্ত কিছুতে ব্রিটিশ ভাস্কর্যের ছাপ। পেল্লায় জানালা, দুধসাদা দরজা, প্রতি বাড়ির দেওয়াল থেকে বাবুই পাখির বাসার মতো ঝুলছে ফুটফুটে লেটার বক্স। কলকাতায় এখন যা অবহেলার, কিন্তু বিলেতে আজও বড় আদরের। আর প্রত্যেক বাড়ির সামনে আলগোছে একটু জায়গা ছাড়া, পোশাকি নাম যার ‘কোর্টইয়ার্ড’। একটা গোল টেবল আর দু’চারটে চেয়ার পাতা তাতে, সন্ধের দিকে গায়ে কোট চাপিয়ে নিশ্চিন্তে দু’পাত্তর নিয়ে যেখানে বসা যেতে পারে। চ্যাথাম স্ট্রিট থেকে এবার বাঁ দিকে ঘুরে যান। অপার্থিব সবুজ তার সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে আপনার উপর। কংক্রিট-হর্ন-পেট্রোলের ধোঁয়ার শহর থেকে এসে সবুজের এমন তীব্রতায় অসহ্য লাগে, চাপ পড়ে দৃষ্টিতে। অনিন্দ্যসুন্দর একটা পার্ক মধ্যিখানে, শিশুরা যেখানে খেলে বেড়াতে পারে দিব্য, ভোরে যে পার্কে জিরোতে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা পাখি। কে জানে, কী নাম ওদের! শুধু অপার্থিব ওরা, বড় অপার্থিব।
ব্যবসা-বাণিজ্যও এ তল্লাটে অফুরান। ওয়াইন বার, কফিশপ, সুপার মার্কেট, মুরগির ফ্রাইয়ের দোকান– কী নেই! আর অধিকাংশ দোকানই চালান ভারতীয়রা। কেএফসি-র কায়দায় চিকেন ফ্রাইয়ের এখানে দোকান দিয়েছেন যাঁরা, জন্মগত ভাবে অন্ধ্রপ্রদেশের। ভারত থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিলেতে চলে এসেছেন বহু দিন, রোজগারের টানে। সাধারণত রাত আটটার পর দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় এলিফ্যান্ট অ্যান্ড ক্যাসল চত্বরে। বাসিন্দাদের কেউ কেউ সাইকেলে (রাস্তায় সে সব সাইকেল পড়ে থাকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, অ্যাপে বুক করতে হয়) করে ফিরে আসেন ঘরে, কেউ আবার লাজরাঙা লাল দোতলা বাস থেকে নেমে হাঁটা দেন গৃহ-অভিমুখে। কিন্তু অন্ধ্রের ওই দুই যুবকের নিস্তার নেই, এতটুকু বিশ্রাম নেই। করবেন কী তাঁরা? দোকানের দরজা ঠেলে তখনও ঢুকে পড়ছে লোকে, ভারতীয় মশলাপাতি সমৃদ্ধ চিকেন চেখে দেখতে! বলা হয়নি আগে, জায়গাটার নৈশজীবনও আছে স্বতন্ত্র, তার নিজের মতো। মাঝরাত পেরিয়েও এখানে কিশোর-কিশোরীরা ভিডিও গেম পার্লারে ডুবে থাকে, ‘পাব জি’ খেলে চুটিয়ে। টিউব স্টেশনের কাছে আবার একটা বার-কাম-রেস্তোঁরা রয়েছে, যেখানে বসার ব্যবস্থাপনা বিবিধ। ভেতরে আপনি বিয়ার নিয়ে বসতে পারেন, অর্ডার করতে পারেন ফিশ অ্যান্ড চিপস। দশ-পনেরো পাউন্ডের মধ্যে হয়ে যাবে। আবার প্রেমিকার হাত ধরে চুপচাপ যদি কিছুক্ষণ বসে থাকতে চান, বাইরে বসুন, কনকনে শীত আর প্রেমের উষ্ণতার মোহানায়। গত রাত্তিরে সেই রেস্তোঁরার বাইরে এক ইংরেজ যুগলকে পাওয়া গেল, বহির্বিশ্ব সম্পর্কে যাদের কোনও আগ্রহ নেই। ভ্রূক্ষেপ নেই। ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে তারা ব্যারিকেড করে বসে!
হে বাঙালি, বুকে হাত রেখে বলুন তো, এই মধ্যবিত্ত চোখে এত কিছু সহ্য হয়?