শ্রীক্ষেত্র আর কালীক্ষেত্রের মধ্যে ভৌগলিক দূরত্ব যেমন অনেকখানি, তেমন দুই তীর্থে দুই আরাধ্যের উপাসনা রীতিতেও আছে বেশ ফারাক। যদিও সাধনার পথটুকুই যা আলাদা, অন্তিমে সব পথ এসে মিলে যায় শেষে তাঁর চরণের কাছেই। তবু রীতিনীতি, বিধিবদ্ধ নিয়মাবলিতে কিছু পার্থক্য তো থেকেই যায়। আবার আশ্চর্যভাবে এই দুই পথের রীতির মধ্যেই অপূর্ব সাদৃশ্যও পরিলক্ষিত হয়। আমরা সেই মিলটুকুই ফিরে দেখতে পারি স্নানযাত্রার আঙ্গিকে। লিখলেন অরিঞ্জয় বোস।
পুরীধামে প্রভু জগন্নাথের স্নানযাত্রার কথা আমরা সকলেই জানি। জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথিতেই এই আয়োজন। মনে করা হয়, এই দিনটিতেই দারুবিগ্রহে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়েছিল জগন্নাথদেবের। অর্থাৎ দিনটি হল প্রভুর আবির্ভাব তিথি বা জন্মদিন। মর্ত্যের বৈকুন্ঠধামে সেদিন তাই যথারীতি আয়োজন ধুমধামের। শ্রীমন্দিরের রত্নবেদী ছেড়ে মহাপ্রভু স্নান করতে বেরিয়ে আসেন স্নানবেদীতে বা স্নান-মণ্ডপে। এই স্নানযাত্রার মাহাত্ম্য আমরা অবগত। মহাপুরুষগণ বলেন, ভক্তিভরে যদি কেউ স্নান-মহোৎসব দর্শন করেন, তবে জীবনের চক্র থেকে তিনি অবর্থ্য মুক্তিলাভ করেন। প্রভু জগন্নাথের এই উপাসনা রীতির সঙ্গে শাক্তমতের সরাসরি সাদৃশ্য না থাকলেও, প্রথার নিরিখে একটি গাঢ় মিল লক্ষ্য করা যায়। দেখা যায়, জগন্নাথের মতোই আবির্ভাব তিথিতে স্নানযাত্রার আয়োজন হয় শক্তিপীঠেও। মহাতীর্থ কালীঘাটেও এদিন সতীঅংশের স্নানের নিমিত্ত হয় বিশেষ পুজোপদ্ধতির আয়োজন। শ্রীক্ষেত্র আর কালীক্ষেত্র যেন মিলে যায় এক বিন্দুতে।
আরও শুনুন: গণধর্মের গণদেবতা প্রভু জগন্নাথ, ভক্তদের দর্শন দেন গজানন রূপেও
শক্তিপীঠের আদিপীঠ কালীঘাটে পড়েছিল সতীর পদাঙ্গুলি। কথিত আছে, স্নানযাত্রার দিনেই কালীঘাটের মন্দিরে মহামায়ার প্রস্তুরীভূত সতীঅঙ্গ হ্রদ থেকে তুলে এনে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দুই ব্রহ্মচারী- আত্মারাম ব্রহ্মচারী ও ব্রহ্মানন্দ গিরি। পুজোর পর দেবীর নির্দেশ মতোই ব্রহ্মবেদীর অগ্নিকোণে (পূর্ব ও দক্ষিণ দিকের মধ্যবর্তী কোণ) সেই প্রস্তুরীভূত পদাঙ্গুলি রেখে দিয়েছিলেন। প্রথা মেনে তাই প্রতি স্নানযাত্রার দিনেই পুনরায় স্নান করানো হয় মহামায়ার সেই প্রস্তুরীভূত পদাঙ্গুলিকে। এই প্রক্রিয়া যেমন ভক্তিভাবপূর্ণ, তেমনই নিবিড় ও গোপন। ভক্ত ও ভগবানের একান্ত সখ্যের নিদর্শন যেন ধরা আছে এই স্নানযাত্রার উৎসবে।
আরও শুনুন: ভক্তের বিশ্বাসেই ভগবান বাবা লোকনাথ, বাড়িতেই কীভাবে করবেন তাঁর পুজো?
বর্তমানে সতীঅঙ্গটি দেবী দক্ষিণা কালীর বিগ্রহের নিচে একটি রুপোর বাক্সে সংরক্ষিত। যেহেতু স্নানযাত্রার দিনে এই পুণ্যবস্তুটি উদ্ধার হয়েছিল, সেজন্য প্রতিবছর এই পবিত্র দিনে বিপুল আয়োজন মহাতীর্থে। যে কোনও সতীপীঠের ক্ষেত্রেই এ এক বিশেষ ক্ষণ। কালীঘাটেও মায়ের পুজোর আয়োজন এদিন অন্যদিনের থেকে বেশ অন্যরকম বলা যায়। সেবায়েতরা ছাড়া এই গুপ্তপুজোর আচার-নিয়ম কেউ জানেন না। সেদিন সেবায়েতরা চোখে কাপড় বেঁধে গর্ভমন্দিরে প্রবেশ করেন, স্নান-উৎসব সম্পন্ন করার জন্য। গোলাপ জল, জবাকুসুম তেল, অগুরু, সুগন্ধি আতর ও গঙ্গাজলের মিশ্রণে স্নান করানো হয় দেবীকে বা সতীঅংশটিকে। দেবীঅঙ্গের আচ্ছাদন হয় সোনার সুতোয় কাজ করা নতুন বেনারসি। স্নান হয়ে গেলে যথাস্থানে আবার সেই পুণ্যবস্তুটি রেখে মন্দিরের দ্বার খোলেন তাঁরা।
আরও শুনুন: সোমবার মিষ্টি, মঙ্গলে ঘি! শাস্ত্রমতে কোন দিনে কোন খাবার নিষিদ্ধ?
আরও একটি কারণে এই উৎসব তাৎপর্যপূর্ণ। শাক্ততন্ত্র ও বৈষ্ণবতন্ত্র- উভয়ই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, কলিযুগে কৃষ্ণ ও কালী অভিন্ন। কালীঘাট মহাতীর্থে এদিন তাই মহামায়ার এক অপূর্ব লীলা সংঘটিত হয়। রাত্রিকালে ও ঊষালগ্নে দেবী দক্ষিণাকালী ভক্তদের দর্শন দেন বৈষ্ণব রূপে। এর নেপথ্যে আছে এক গল্প, সে প্রসঙ্গে আসি। শোনা যায়, একদিন গভীর রাতে ভবানীদাস চক্রবর্তী নামে জনৈক সেবায়েত অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখেন। দেখেন, স্বপ্নাদেশে স্বয়ং জগন্মাতা তিলক পরার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন। মায়ের ইচ্ছে অপূর্ণ রাখেননি ভবানীদাস। দেবী বিগ্রহের নাসিকাগ্রে শ্বেতচন্দনের তিলক পরিয়ে দেন। সেই থেকে বৈষ্ণবরূপে ধরা দেন জগজ্জননী দক্ষিণ কালী।
সমন্বয়ের এই স্বর্ণসূত্রটিও সাদরে রক্ষিত আছে স্নানযাত্রার এই মহোৎসবে। শ্রীক্ষেত্র আর কালীক্ষেত্র, শাক্ত আর বৈষ্ণব মত – সবই যেন স্নাত হয় ঈশ্বরের অপার করুণায় আর ভক্তহৃদয়ের বিগলিত পুণ্যধারায়। এই মিলনমন্ত্রেই মহিমাণ্বিত হয়ে ওঠে স্নানযাত্রার মহালগ্নটি।