পরম ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও রাবণের অপরাধ ক্ষমা করেননি স্বয়ং মহাদেব। সীতাকে অপহরণ তো রাবণ করেইছিলেন, তা-ও আবার সাধুর ছদ্মবেশে। ঠিক এইখানেই তাঁকে ক্ষমা করতে নারাজ দেবাদিদেব। আর ধর্মীয় আখ্যানের ভিতর থেকেই অধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এই পথ চিনিয়ে দিয়ে গেল মনোজ বাজপেয়ীর কোর্টরুম ড্রামা ‘স্রিফ এক বান্দা কাফি হ্যায়’। হাড্ডাহাড্ডি আইনি লড়াই শুধু নয়, এ ছবি যেন সাম্প্রতিক সময়ে আরও বড় বার্তা নিয়েই উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আসুন শুনে নিই ছবির সেই দিকটি।
‘স্রিফ এক বান্দা কাফি হ্যায়’! মনোজ বাজপেয়ীর নতুন সিনেমাটির নাম দেখে যেন খটকা লাগে। সত্যিই কি একজন মানুষ যথেষ্ট! অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে এককের সংগ্রাম কতটাই বা সফল হতে পারে! ছবির পরতে পরতে লুকিয়ে আছে তার উত্তর। একা মানুষের লড়াইও যে বৃহত্তর পরিবর্তনের প্রথম পদক্ষেপ হয়ে উঠতে পারে, এ ছবির শেষে সেই বোধেরই প্রতিষ্ঠা। আর সেই সঙ্গে এই ছবি যেন চিরায়ত প্রতিরোধের একটি রাস্তাকেও নতুন করে চিনিয়ে দিয়ে গেল কোর্টরুম ড্রামার মোড়কে।
আরও শুনুন: ধর্ম বদল হয়নি পাত্রীর, ১০০ বছর আগে বিয়েতেও ‘বিদ্রোহী’ ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম
এক স্বঘোষিত ধর্মগুরুর বিরুদ্ধে, নিজের আশ্রমেই এক নাবালিকাকে যৌন হেনস্তার অভিযোগ উঠেছে। ছবির গল্প আবর্তিত হছে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে। প্রভাবশালী ধর্মগুরুর হয়ে আইনি লড়াই লড়তে আসছেন দেশের তাবড় আইনজীবীরা। অন্যদিকে লাঞ্ছিতা মেয়েটির হয়ে লড়াইয়ে নেমেছেন মনোজ বাজপেয়ী অভিনীত চরিত্রটি। তাঁর সেই একার লড়াই কতটা ‘কাফি’ হয়ে উঠবে, সে তো যাঁরা ছবিটি দেখবেন, তাঁরা জানবেনই। তবে, এ-ছবি ধর্ম আর ধর্মের নামে অধর্মের বাতাবরণটিকে খুব স্পষ্ট করে দেয়। যা এই সময়ে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে হয়।
আরও শুনুন: বাস মুম্বইয়ের বস্তিতে, হলিউডের পরিচালকরা খুঁজছেন সেই কিশোরীকেই
ছবিতে মনোজ বাজপেয়ী হয়েছেন আইনজীবী পি সি সোলাঙ্কি। তিনি পরম ধার্মিক। মহাদেবের ভক্ত। পুজো না করে কোর্টে যান না। এমনকী কোর্টরুমে সওয়ালের মোক্ষম মুহূর্তের আগেও তাঁকে আরাধ্যকে স্মরণ করে নেন। এ হল ধর্ম আশ্রয়ের একটা দিক। অন্যদিকে আছেন অভিযুক্ত ধর্মগুরু। হাজার হাজার ভক্ত তাঁর। দেশের বিভিন্ন শহরে তাঁর আশ্রম। তাঁর নামে চলছে বিপুল কর্মকাণ্ড। হসপিটাল থেকে স্কুল পর্যন্ত চলে এই আশ্রমের তত্ত্বাবধানে। এই ধর্মগুরুই একদিন অভিযুক্ত হলেন এক নাবালিকাকে যৌন হেনস্তায়। সাহসে ভর করে নাবালিকা পুলিশের দ্বারস্থ হলে, শুরু হয় আইনি লড়াই। মনোজ বাজপেয়ীর সেরার সেরা অভিনয় হয়তো এটা নয়, তবে যেভাবে তিনি ছবিটিকে গতি দিয়েছেন, বিশেষত কোর্টরুমের দৃশ্যগুলিকে যেভাবে নিজের দখলে এনে দর্শককে টেনে রেখেছেন, তার তুলনা হয় না। সে প্রসঙ্গ আলাদা। আমরা ফিরে যেতে পারি ছবি যে অভিমুখে এগিয়ে চলে, তার চূড়ান্ত বিন্দুটিতে। দীর্ঘ পাঁচ বছরের আইনি লড়াই। প্রমাণ, পালটা প্রমাণ। সওয়াল-জবাব। যুক্তি-প্রতিযুক্তির বন্যা বয়ে যায়। দেশের তাবড় আইনজীবীরা তাঁদের সমস্ত কৌশল প্রয়োগ করেন। অন্যদিকে সোলাঙ্কির সম্বল দেশের আইনের প্রতি গভীর নিষ্ঠা। আরও একটি অবলম্বন ছিল, তা হল- ধর্ম। যা আচার-বিচার-প্রথার নিগড়ে আবদ্ধ নয়, বলে ন্যায়ের কথা। ছবিতে এল চূড়ান্ত সওয়ালের মুহূর্ত। ধর্মগুরুর আইনজীবী জানালেন, তাঁর মক্কেলের দণ্ডবিধানের অর্থ মানবসেবায় তাঁর যা কর্মকাণ্ড সব এক লহমায় স্তব্ধ করে দেওয়া। স্কুলে আর গরিব বাচ্চারা পড়তে পারবে না, ‘বাবা’র প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে চিকিৎসা পাবেন না সাধারণ মানুষ, অভুক্তর মুখে আর খাবার তুলে দেওয়া হবে না। অতএব, আইনজীবীর স্পষ্ট কথা চূড়ান্ত বিচারের আগে যেন এই কথাগুলো মাথায় রাখা হয়।
আরও শুনুন: রাজা হয়েও যেন সন্ন্যাসী! শীর্ষে থেকেও মাটির মানুষ হয়ে থাকার নামই অরিজিৎ সিং
ঠিক এইখানেই আসে ছবিটির শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। যখন নিজের বক্তব্যে সোলাঙ্কি টেনে আনলেন আমাদেরই সনাতন ধর্মীয় আখ্যানের প্রসঙ্গ। শিবের পরম ভক্ত হলেও, রাবণকে মৃত্যুর পরেও ক্ষমা করতে নারাজ ছিলেন দেবাদিদেব মহাদেব। পার্বতী এর কারণ জিজ্ঞেস করলে শিব বলেন, রাবণ পাপ করেছেন তো বটেই। তবে, পাপেরও রকমফের আছে। কোনও কোনও পাপ হয়তো ক্ষমা করা যায়। সীতাকে হরণ করে রাবণ নিজের পাপের বোঝা ভারী করে তো তুলেইছেন, তার থেকেও গর্হিত যে কাজ তিনি করেছেন, তা হল এই অপহরণ করে তিনি করেছেন সাধুর বেশ ধরে। সাধুর প্রতি মানুষের যে ভক্তি ও বিশ্বাস, তার উপরই প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে রাবণের এই কাজ, যার প্রভাব পড়বে যুগে যুগে। শিব তাই একে চিহ্নিত করছেন মহাপাপ হিসাবে, এবং পার্বতীকে বলে দিচ্ছেন, এই মহাপাপ ক্ষমার অযোগ্য। সোলাঙ্কি ঠিক এই জায়গাটা তুলে ধরে বলতে চান, ধর্মগুরুর ভেক ধরে স্বঘোষিত ‘বাবা’ যেভাবে মানুষের বিশ্বাসকে পদলিত করেছেন, তার কোনও ক্ষমা হতে পারে না।
আরও শুনুন: RAW আর ISI অফিসারের কি সত্যিই প্রেম হয়? ‘পাঠান’ প্রসঙ্গে জবাব প্রাক্তন RAW প্রধানের
শেষমেশ শাস্তি কি পেলেন ওই স্বঘোষিত বাবা? উত্তর রাখা আছে ছবিতে। আমরা সে উত্তরে যাব না। শুধু প্রতিরোধের এই ধরনটি এই সময়ে যেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ধর্মের নামে অপরাধ যখন প্রায়শই সংবাদের শিরোনামে উঠে আসে, আর কাঠগড়ায় ওঠে ধর্মবিশ্বাস, সেরকম একটা সময়ে দাঁড়িয়ে এই ছবি বলে, ধর্ম কখনও অধর্মকে প্রশ্রয় দেয় না। ধার্মিকের বেশ ধরে যাঁরা যে অপরাধ করে চলেছেন, তাঁরা ক্ষমার অযোগ্য। ধর্ম ন্যায়ের কথাই বলে। আর এ-কথা সোলাঙ্কি বলছেন ধর্মীয় আখ্যানের অন্দর থেকেই, মনগড়া কথা হিসাবে নয়। আমাদের মনে পড়বে, বিধবাবিবাহের জন্য বিদ্যাসাগর যখন লড়াই করেছিলেন, তখন শাস্ত্রের বাণী দিয়েই খণ্ডন করেছিলেন শাস্ত্রের নামে বয়ে চলা তথাকথিত ধার্মিকদের অযৌক্তিক মতবাদ। ধর্মের ভিতরেই যেন আছে অধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রসদ। এই অসহিষ্ণু সময়ে দাঁড়িয়ে এই কথাটি যে সোচ্চারে বলতে পারল এই ছবিটি, তাঁর জন্য অবশ্যই সাধুবাদ পাবেন পরিচালক অপূর্ব সিং কার্ফি। সত্যি, যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে একজন মানুষই যথেষ্ট, যদি থাকে ন্যায় তথা ধর্মের যথার্থ অবলম্বন। ছবিশেষে এই অনুভবই বড় প্রাপ্তি দর্শকের।