দেবী মাত্রই মহামায়ার স্বরূপ। তবে দেবী ষষ্ঠী লৌকিক দেবী হিসেবেই অধিক পরিচিতা। প্রতি মাসেই ষষ্ঠী তিথিতে বিভিন্ন নামে এই দেবীর পুজোর চল রয়েছে। বাংলা ব্রতের নিয়মে জ্যৈষ্ঠ মাসের ষষ্ঠী তিথি হল অরণ্যষষ্ঠীর দিন। লোকমতে এর নামই জামাই ষষ্ঠী। কী নিয়ম এই ব্রতের? আসুন শুনে নিই।
সন্তানের সুস্থতা কামনায় দেবী ষষ্ঠীর আরাধনা করা হয়। লৌকিক নিয়মেই পুজো হয় দেবীর। শাস্ত্রে সেই অর্থে দেবীর উল্লেখ নেই বললেই চলে। তাই দেবী মূর্তির কোনও নির্দিষ্ট ব্যখ্যা নেই। ব্রতের নিয়মে উল্লেখ মেলে, দেবীর বাহন বিড়াল। কোলে রয়েছে এক সন্তান। বিশেষ কোনও অস্ত্র নেই। তবে এই আকারে মূর্তি গড়ে ষষ্ঠী পুজো সচরাচর দেখ যায় না। তা হয় মূলত অশ্বত্থ গাছ বা জলের উপর।
আরও শুনুন: ঠকাতে হবে নতুন জামাইকে! জামাইষষ্ঠী উপলক্ষেই বাঙালির পাতে এল ‘জলভরা’
প্রতি মাসেই ষষ্ঠী ব্রত পালনের নিয়ম রয়েছে। যার মধ্যে মূলোষষ্ঠী, দুর্গাষষ্ঠী কিংবা ষষ্ঠী উল্লেখযোগ্য। তবে সেসবেই গেরস্তের অন্দরমহলের ব্রত। এমনও এক ষষ্ঠী রয়েছে যা কোনও অংশে সামাজিক উৎসবের থেকে কিছুমাত্র কম নয়। কারণ এই ষষ্ঠী সরাসরি নিজের সন্তানের জন্য পালন করা হয় না। বুঝতেই পারছেন, কথা বলছি জামাই ষষ্ঠী সম্পর্কে। জামাইয়ের মঙ্গল কামনায় শাশুড়িরা এই ব্রত পালন করেন। তবে শুধুমাত্র জামাই আদর নয়, এই বিশেষ ব্রত পালন করলে বাড়ির অন্যান্য সদস্যদেরও মঙ্গল হয়। বিভিন্ন লোকাচার মিশে তা হয়তো কেবলমাত্র জামাই কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে, তবে ব্রতকথায় শুধুমাত্র জামাই আদরের উল্লেখ নেই। আর এই ধরনের ব্রতের ক্ষেত্রে ব্রতকথাকেই সারবত্তা হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। সেখানে অবশ্য এর নামও জামাই ষষ্ঠী নয়। সেখানে এর উল্লেখ মেলে অরণ্যষষ্ঠী হিসেবে। ব্রতের নিয়ম অন্যান্য ষষ্ঠীব্রত-র মতোই। উপকরণ হিসেবে রাখতে হয়, ৬ টি ফল, ৬টি পান, ৬টি সুপুরি, বাঁশপাতা, হলুদ কাপড়ের টুকরো, নতুন ৬ গাছা সুতো, একটি হাতপাখা, তেল-হলুদ ও টকদই। ব্রতের নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে সমস্ত ফল একসঙ্গে একটি ঝুড়ি বা পাত্রে সাজিয়ে রাখতে হয়। তারপর সেখানে ৬টা পান ও ৬টা সুপুরি রাখতে হয়। সেই সঙ্গে রাখতে হয় হলুদ কাপড়ের টুকরো ও একটি বাশ পাতা। অন্য একটি পাত্রে ৬ গাছা সুতো তেল-হলুদ মাখিয়ে রাখতে হয়। এই সুতোকে ষাট সুতো বলা হয়। আলাদা পাত্রে রাখতে হয় দই। এরপর ভক্তিভরে মা ষষ্ঠীর পুজো করতে হয়। পুজোর শেষে ছেলে-মেয়েদের কপালে দই ও হলুদের ফোঁটা দিতে হয়। সবশেষে হাতে সুতো বেঁধে হাতপাখা দিয়ে হাওয়া দিতে হয়। সেইসময় সন্তান বা জামাইয়ের কোলে ওই ফলের পাত্র রাখতে হয়। পুজোর শেষে ব্রতকথা শুনতে হয়। তবেই সম্পূর্ণ হয় ব্রত।
আরও শুনুন: ভূরিভোজে সন্তুষ্ট করতে হবে জামাইকে… কোথা থেকে এল এই জামাইষষ্ঠীর রীতি?
সেই ব্রতকথা খানিকটা এরকম,নিজে মাছ চুরি করে খেয়ে পোষা বেড়ালের নামে দোষ চাপিয়েছিল এক বাড়ির বউ। বাহনের এমন অপমান দেখে মা ষষ্ঠী রীতিমতো রেগে যান। শাস্তি দিতে একাধিকবার সেই মহিলার সন্তান চুরি করেন তিনি। নিজের ভুল বুঝতে পেরে বনে গিয়ে ষষ্ঠীর পুজো করে সেই বউ। সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে সন্তান ফিরিয়ে দেন দেবী। কিন্তু মুশকিল হল, এইসব কাণ্ডের জেরে শ্বশুরবাড়ি থেকে বউয়ের বাপের বাড়ি যাওয়া চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। তখন জামাইষষ্ঠীর ছল করেই জামাই, সঙ্গে মেয়েকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন ওই বউয়ের মা-বাবা। যদিও এই ধরনের আরও কিছু উপাখ্যান দেবী ষষ্ঠীর ব্রতকথা হিসেবে প্রচলিত রয়েছে। আবার কারও কারও মতে, সেকালে সন্তানজন্মের আগে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার উপায় ছিল না তার মা-বাবার। তাই এই জামাইষষ্ঠী একদিকে মেয়েকে দেখতে পাওয়া, আবার ষষ্ঠী দেবীর পূজা করে তার সন্তানজন্মের বরটুকুও চেয়ে নেওয়া।