মন্দির চত্বরে অনুষ্ঠান, তাই রাখা যাবে না কাজী নজরুল ইসলামের ছবি। সম্প্রতি এমনই নির্দেশিকা জারি হয়েছিল নবদ্বীপের এক মন্দিরে। ঘটনার প্রেক্ষিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন উঠেছিল, বাঙালি কি নিজের শিকড় ভুলতে বসেছে? তবে এই প্রেক্ষিতেই বাংলার সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম কেন্দ্র কফি হাউসে ধরা পড়ল এক অন্য ছবি। সেখানে রবি ঠাকুরের বিখ্যাত ছবিটির পাশেই সম্প্রতি রাখা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের ছবিও। এ বিষয়ে কী বলছে কফি হাউস কর্তৃপক্ষ? খোঁজ নিলেন শুভদীপ রায়।
‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/ আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নি কো নজরুল’- সেই কবে এই সারকথা জানিয়ে দিয়েছিলেন কবি অন্নদাশঙ্কর রায়। রাজনীতির ভাগের চুরি বাংলার ভূমিকে দ্বিখণ্ডিত করতে পারলেও, বাঙালির আত্মাকে করতে পারেনি। আর তাই সব বাঙালির কাছেই প্রাণের মানুষ হয়ে থেকেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। তবে সাম্প্রতিক এক ঘটনায় যেন ছিল ছন্দপতনের ইঙ্গিত। মন্দির সংলগ্ন জায়গায় রবীন্দ্র-নজ্রুল সন্ধ্যা পালন হবে, অথচ সেখানে রাখা যাবে না কাজী নজরুলের ছবি। এমন নির্দেশ ঘিরেই তৈরি হয়েছিল বিতর্ক। বাঙালি তার প্রতিবাদ করে। পরে ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশও করে মন্দির কর্তৃপক্ষ। তবে ঘটনাটি যে বাঙালি সংস্কৃতির দৈন্য তুলে ধরেছিল, তারই উলটো ছবি দেখা গেল কলকাতার কফি হাউসে।
বাঙালির সংস্কৃতি চর্চার এই প্রাণকেন্দ্রে সম্প্রতি রবি ঠাকুরের পাশেই রাখা হয়েছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছবিও।
সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের ইন্দ্র-মিত্র-বরুণদের আড্ডা দেওয়ার জায়গা কফি হাউস। সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালির পীঠস্থানই বলা চলে একে। আর সেখানে ঢুকলেই সবার আগে চোখ যায় রবি ঠাকুরের পূর্ণাবয়ব ছবিটির দিকে। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’-র দৃশ্যে অভিনয়রত কবিগুরুর এই বিখ্যাত ছবির সঙ্গে সকলেরই পরিচিত। সম্প্রতি তার পাশেই টাঙানো হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের ছবিও। যে বাংলা এখনও নিয়ম করে রবীন্দ্র-নজ্রুল সন্ধ্যার আয়োজন করে, সেখানে অবশ্য এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাটি বাঙালির সেই সাংস্কৃতিক চর্চা এবং উদার সম্প্রীতির বাতাবরণ নিয়েই যেন প্রশ্ন তুলেছিল। সেই ক্ষতে যেন প্রলেপ হয়েই এল কফি হাউসের এই দৃশ্য। জানা যাচ্ছে, মাসকয়েক আগে নতুন করে সাজানো হয়েছে কফি হাউসের ভিতরের অংশ। দেওয়ালে নতুন রং-ও করা হয়েছে। সেই সঙ্গে যোগ করা হয়েছে কয়েকটি নতুন ছবি। যার মধ্যে অবশ্যই রয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের একটি ছবি। ছবিতে নজরুলের বিখ্যাত উক্তিও লেখা রয়েছে।
ছবিটি টাঙানো হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ছবির ঠিক পাশেই। জানা গিয়েছে, এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাই কফি হাউস কর্তৃপক্ষের কাছে এই প্রস্তাব এনেছিল। তাতে সর্বান্তকরণে সম্মতি জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সংস্থার বর্তমান সেক্রেটারির মতে, “বাংলার দুই বিখ্যাত কবি একসঙ্গে স্থান পাবেন, এটাই তো স্বাভাবিক।” তবে নবদ্বীপের ঘটনাটিকে খুবই দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করেছেন তিনি। একই দাবি কফি হাউসের যাঁদের নিত্য আসা-যাওয়া তাঁদেরও। তাঁরাও কফি হাউসে নজ্রুলের ছবি দেখে বেশ খুশিই হয়েছেন।
কফি হাউসেও যে কেবলমাত্র একটি ছবি টাঙানো হয়েছে তা নয়। উল্টোদিকের দেওয়ালেও পাশাপাশি আছেন রবি ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম। পাশেই আছেন জীবনানন্দ দাশও।
আরও শুনুন: মণিপুর থেকে কান… কেন নগ্নতাকেই প্রতিবাদের হাতিয়ার করে তোলেন নারীরা?
বাঙালি যে এখনও তার শিকড় ভুলে যায়নি, কফি হাউস যেন সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে বাংলায় একই সঙ্গে পালিত হয় রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা। বাংলার আবহমানের সংস্কৃতিকেই যেন তুলে ধরল বাঙালির সংস্কৃতিচর্চার প্রাণকেন্দ্র কফি হাউস।