রিঙ্কু সিং জানেন এ জীবন তাঁকে বারবার সুযোগ দেবে না। ভাগ্যের মার তাঁকে কোথাও না কোথাও বিপর্যস্ত করবেই। চূড়ান্ত ফর্মে থাকাকালীন প্লে-অফ-এর আগেই ছিটকে যাওয়া হয়তো সেরকমই এক মার। রিঙ্কু সিং তা মেনে নেন হাসিমুখেই। কিন্তু তিনি জানেন, এই এত প্রতিকূলতার বদ্ধ গড়ের ভিতর আলো আনতে হবে তাঁকেই। জীবন তাঁকে হারাতে চাইবে, তবু হারার ফাঁদে পা দিলে চলবে না। বরং ওর ফাঁকেই দেখিয়ে দিতে হবে, ইতিহাস বড় জয়ের ধারাবিবরণী হয়ে উঠতে চায় বটে, তবে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষও নিজের জেদে লিখে রাখতে পারেন তাঁর নিজস্ব ইতিহাস। সে ইতিহাসকেই কেউ কেউ হয়তো বলবেন রূপকথা।
‘রিঙ্কু সিং নট আউট’। স্কোরবোর্ড থেকে যেন জীবনের দিকে উড়ে যাচ্ছে কথাটা। উড়ে যাচ্ছে জাগতিক যত হেরে যাওয়ার উপর অলৌকিক ছায়া ফেলতে ফেলতে। ভাগ্যের মার খেতে খেতে মুখ থুবড়ে পড়া ছাপোষা মানুষের ডানা-ভাঙা-স্বপ্নের উপর অপূর্ব উপশম হয়ে নেমে আসছে কথাটা- রিঙ্কু সিং নট আউট। এ তবু অলৌকিক কোনও কাহিনি নয়। বরং লৌকিক পৃথিবীরই স্বপ্নসন্ধানের গল্প। বলা ভাল, গল্প হলেও সত্যি।
‘রিঙ্কু সিং নট আউট’ এক রূপকথারই নাম। তবে সে-রূপকথা কল্পনার তুলিতে নয়, বরং লেখা হয়েছে ঘাম আর শ্রমে।
এই ক্রিকেট খেলার জন্যই তো বাবার হাতে মার খেয়েছিলেন। বাবারই বা আর দোষ কোথায়! গ্যাস সিলিন্ডার ডেলিভারি করে সামান্য উপার্জন। দু-কামরার ঘরে বসে থাকা অনেকগুলো মানুষের খিদের গল্প তাঁকে তো নিয়ত তাড়া করছে। এমন সংসারে ক্রিকেট খেলার বিলাসিতা কি মানায়! রিঙ্কুর শ্রমজীবী বাবা জীবনের মার খেতে খেতেই বুঝেছিলেন, ব্যাটের ঔদ্ধত্যে বোলারকে ছক্কা মারার থেকে অনেক বেশি জরুরি পেটের ভাত জোটানো। দিনরাট ব্যাট নিয়ে পড়ে থাকার থেকে বরং পড়াশোনায় মন দেওয়া ভাল। অতএব ক্রিকেট খলতে নেমে রিঙ্কুর কপালে জুটল বাবার মার। আসলে সে মার জীবনেরই। সকলেই জানেন না, তবে রিঙ্কু জানেন, কী করে সেই মারের মুখের উপর দিয়ে ফুল তুলে আনতে হয়। এমনি এমনি তো আর জীবনের রূপকথা লেখা হয় না।
‘রিঙ্কু সিং নট আউট’ এক রূপকথাই। তবে সে-রূপকথা লেখা হয় মানুষের লড়াই, জেদ আর স্বপ্নসন্ধানে।
জীবন আদতে এক জেদি রাজপুত্র। সে সকলকে নিজের বশ্যতা শিকার করতে বাধ্য করে। অন্তত চেষ্টা তো করে যায়। আর তখনই খিদের রাজ্যে ঝলসানো রুটি হয়ে ওঠে বহু স্বপ্ন। রুটিরুজির সন্ধানে মানুষকে সরিয়ে রাখতে হয় স্বপ্নের সাতমহল। রিঙ্কুকেও হয়তো তাই করতে হত। রিঙ্কুর ভাই এক কোচিং সেন্টারে ঝাড়ুদারের কাজ করতেন। রিঙ্কুর কপালেও জুটেছিল সেই কাজ। ঝাড়পোঁছ করেই হয়তো দিন কাটত তাঁর। কিন্তু একটা স্থির সিদ্ধান্ত পালটে দিল সবকিছু। জীবন সেদিন দেখেছিল, তার থেকেও জেদি এক যুবরাজকে। রাজার বৈভব তাঁর নেই। কিন্তু আছে জেদ আর আত্মবিশ্বাসের অবিশ্বাস্য ভাঁড়ার। যার কিছুই নেই, তারও আছে অফুরন্ত লড়াইয়ের মূলধন। অতএব রিঙ্কু স্থির করলেন, জীবনটাকে হেলাফেলায় বয়ে যেতে দেবেন না তিনি। ক্রিকেটই খেলবেন। জেদি জীবন কি সেদিন রিঙ্কুর জেদ থেকে একটু বিস্মিতই হয়েছিল! হয়তো বা! নইলে আর জীবনের রূপকথা এভাবে লেখা হয় কী করে।
‘রিঙ্কু সিং নট আউট’ এক রূপকথারই নাম। সে-রূপকথা লেখা হয় ক্লান্তিকে হারানো জীবনের ক্রান্তিলগ্নে।
স্বপ্ন ছোঁয়ার শীর্ষবিন্দু কতদূরে কে জানে! তবে সাধারণ মানুষ জানে, সে-গন্তব্যে পৌঁছাতে গেলে তাকে বাধার পাহাড়খানা ভাঙতে ভাঙতেই এগোতে হবে। রিঙ্কু সিং-ও তা-ই জানতেন। আর তাই সকলে যখন ঘুমিয়ে, তিনি উঠে তখন দৌড় শুরু করতেন তাঁর স্বপ্নের দিকে। শারীরিক কসরত সেরে ব্যাটে-বলে মন দেওয়া। বহু বাধার সামনেও শৃঙ্খলায় হেলা দেননি রিঙ্কু। একদিন এক টুর্নামেন্ট খেলে বাইক জিতলেন। সেই বাইক তুলে দিলেন বাবার হাতে। সিলিন্ডার ডেলিভারির কষ্ট যাতে একটু লাঘব হয়। জীবনের তাপে শুকিয়ে যাওয়া রিঙ্কুর বাবার দুই চোখ কি সেদিন আশায় অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল! হয়তো বা। অন্তত সেদিন থেকে তিনিও বিশ্বাস করতে চাইছিলেন, ছেলে পারবে! রিঙ্কুর নিজের বিশ্বাস চারিয়ে গিয়েছিল তাঁর পরিবারের মধ্যে। এই সেই ক্রান্তিলগ্ন যখন জীবনের ক্লান্তিকে হারিয়ে জিতে যায় মানুষ। সচরাচর তা ঘটে না। তবে দৈবাৎ তা ঘটে বলেই, আজও লেখা হয় জীবনের রূপকথা।
‘রিঙ্কু সিং নট আউট’ রূপকথাই। যে-রূপকথা লেখা হয় শ্রমজীবী মানুষের অবিশ্বাস্য কাজে ফিরিয়ে দেওয়া উপহাসের নীরব জবাবে।
রিঙ্কু সিং যখন আইপিএল-এ খেলতে এলেন তখনই হয়তো হতাশার চৌকাঠ পেরিয়ে স্বপ্নের খানিক সমীপবর্তী হয়েছিল তাঁর পরিবার। তবে রিঙ্কুর যাত্রাপথে ছিল আরও কাঁটা। গোড়ার দিকে তাঁকে নিয়ে কম উপহাস হয়েছে! এমনকী এই কেকেআর-এর সমর্থকরাও রীতিমতো বৈঠকী মশকরা করতেন তাঁকে নিয়ে। রিঙ্কুর কানে কি পৌঁছাত সে-কথা। হয়তো বা, কিংবা নয়। তবে রিঙ্কুরা জানেন, তাঁদের জন্য ফুলের ডালা নিয়ে কেউ বসে থাকেন না। বরং উপহাস, পরিহাসের কাঁটাই তাঁদের নিত্যসঙ্গী। আর তাই সেই কাঁটার বুকে ফুল ফোটানোর কাজটি করতেই হবে তাঁকে। কেকেআর ফ্র্যাঞ্চাইজি তাঁর উপর ভরসা রেখেছিলেন। সেই ভরসার সিঁড়িতে পা রেখেই সমস্ত উপহাসের জবাব যেন রিঙ্কু দিলেন এই সিজনে। আসলে বাবুসমাজের উন্নাসিকতা কবে আর শ্রমজীবী মানুষের স্বপ্ন,সম্ভাবনাকে কদর করেছে! তবু সেই শ্রমজীবী মানুষই নীরব উপেক্ষার জবাব দিয়ে থাকেন তাঁদের কাজে। সে ভোটের ময়দান হোক বা অন্য ক্ষেত্র, সাধারণই লিখে দিতে পারেন শেষ কথাটি। যেমন রিঙ্কু দিলেন। চলতি আইপিএল-এ কেকেআর সমর্থকদের হাতে যখন পেনসিল ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, তখন সমস্ত ক্ষতের উপর প্রাপ্তি হয়ে নেমে এলেন সেই রিঙ্কু সিং আর তাঁর স্বরচিত ঘাম আর শ্রমের রূপকথা- রিঙ্কু সিং নট আউট।
আসলে রিঙ্কু সিংরা আউট হন না। জীবনের গুগলি বহুবার সময়ের ব্যাট-প্যাডের ফাঁক দিয়ে গলে গিয়ে বোল্ড করে দেয় বলেই, একসময় জীবনকে গুগলি দেওয়ার পালটা চাল শিখে নেন রিঙ্কু সিংরা। তখনই আসে পাঁচ বলে পাঁচ ছয়। কিংবা তিন বলে ছ-চার-ছয়ের অবিশ্বাস্য আকাশ। রিঙ্কু সিং জানেন এ জীবন তাঁকে বারবার সুযোগ দেবে না। ভাগ্যের মার তাঁকে কোথাও না কোথাও বিপর্যস্ত করবেই। চূড়ান্ত ফর্মে থাকাকালীন প্লে-অফ থেকে ছিটকে যাওয়া হয়তো সেরকমই এক মার। রিঙ্কু সিং তা মেনে নেন হাসিমুখেই। কিন্তু তিনি জানেন, এই এত প্রতিকূলতার বদ্ধ গড়ের ভিতর আলো আনতে হবে তাঁকেই। জীবন তাঁকে হারাতে চাইবে, তবু হারার ফাঁদে পা দিলে চলবে না। বরং ওর ফাঁকেই দেখিয়ে দিতে হবে, ইতিহাস বড় জয়ের ধারাবিবরণী হয়ে উঠতে চায় বটে, তবে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষও নিজের জেদে লিখে রাখতে পারেন তাঁর নিজস্ব ইতিহাস। সে ইতিহাসকেই কেউ কেউ হয়তো বলবেন রূপকথা। যে রূপকথা লেখা হয় ঘামে আর শ্রমে। জেদে আর আগুনে। বিশ্বাসে আর ভরসায়। আর স্বপ্ন দেখার দুঃসাহসে। ‘রিঙ্কু সিং নট আউট’ সেরকমই এক সাধারণের অসাধারণ ইতিহাস, আদতে দুঃসাহসিক এক রূপকথা।