সময় বদলেছে। বদলে গিয়েছে তাঁর চরিত্রদের অভিযাত্রা। আর পাঠক ক্রমশ সাক্ষী থেকেছেন সময়ের এক ধ্রুপদী যাত্রার। অনুধাবন করেছেন, আসলে অন্য কেউ নয়, এই ধাবমান কালই ভাস্বর হয়ে আছে তাঁর সাহিত্যযাত্রার অন্দরে।
কালবেলার দহন। আগুন-আন্দোলন-প্রেম। জীবনের আখ্যান থেকে হয়ে-ওঠা ইতিহাস। সমরেশ মজুমদার বাঙালির সেই ধ্রুপদী ঔপন্যাসিক যিনি তাঁর আখ্যানের অন্তর্গত করে নিতে পারেন সমকালের দগ্ধজীবনকে। কয়েক প্রজন্ম ধরে বাঙালি পাঠক যে তাঁর সাহিত্যভুবনে বাঁধা পড়েছে, তার প্রধান কারণ বোধহয় এই যে, অক্ষরকেই জীবনের সার্থকতম আয়না করে তুলেতে পেরেছিলেন। সমকাল পেরিয়ে আগামীও যেখান থেকে চিনে পারবে তার স্মৃতি ও সত্তাকে।
এই বাংলার পথ ধরেই হেঁটে গিয়েছে অনিমেষ আর মাধবীলতা। তারা কি কেবলই সাহিত্যের চরিত্র? বাঙালি পাঠক যেন তা আজও বিশ্বাস করতে পারে না। উত্তাল সত্তর যে স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গ নিয়ে বাঙালির ভাগ্যাকাশে দেখা দিয়েছিল, তার এক ঐতিহাসিক দলিলই বলা যায় ‘কালবেলা’ থেকে ‘মৌষলকাল’ পর্যন্ত সমরেশ মজুমদারের সাহিত্যযাত্রাকে। তা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে বিস্তর। কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করেছেন। তা সত্ত্বেও এ-কথা অনস্বীকার্য, একটা বিক্ষুব্ধ সময়কালকে যে আবেগ দিয়ে তিনি উপন্যাসের আদলে বর্ণনা করে গিয়েছেন, তার আবেদন মানবিকতার বৃহত্তর অলিন্দে। আর তাই বাঙালি পাঠক তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে আপন করে নিয়েছে বহুকাল।
সাহিত্যপ্রিয় বাঙালি বহু সাহিত্যিককেই মনের মণিকোঠায় স্থান দিয়েছেন। বাঙালির সাংস্কৃতিক মননে সাহিত্যের জায়গা চিরকালই স্বতন্ত্র। সেখানে শুধুমাত্র কলমের জোরেই কেউ কেউ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন নক্ষত্রসম। সমরেশ মজুমদার সেই ঘরনারই উজ্জ্বল পথিক। সমকালের রাজনীতিকে আশ্রিত তাঁর উপন্যাস যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তার নমুনা বড় একটা মেলে না। বাঙালির ইতিহাস বয়ে যায় আখ্যানে আখ্যানেই। সেই চিরায়ত রীতিতে যেন আধুনিকতার মোহর দিয়েছিলেন তিনি। ঐতিহাসিক দিক থেকে তা গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ সেই রাজনীতির স্রোতের ভিতর দিয়েই মানুষের মনের অন্তঃস্রোতের যে ধারাবাহিকতা উঠে এসেছে। সময় বদলেছে। বদলে গিয়েছে তাঁর চরিত্রদের অভিযাত্রা। আর পাঠক ক্রমশ সাক্ষী থেকেছেন সময়ের এক ধ্রুপদী যাত্রার। অনুধাবন করেছেন, আসলে অন্য কেউ নয়, এই ধাবমান কালই ভাস্বর হয়ে আছে তাঁর সাহিত্যযাত্রার অন্দরে।
সমরেশ মজুমদার বাঙালির প্রিয় লেখক। শৈশব কেটেছিল উত্তরবঙ্গে। উত্তরবঙ্গের জীবন তাঁর সাহিত্যে উঠে এসেছেও বটে। তবে গোটা বঙ্গই তাঁর সাহিত্যের উত্তরাধিকারকে আগলে রেখেছে। কালের যাত্রায় নিরুদ্দেশ হলেন স্রষ্টা। তবু বাঙালির মনের বারান্দায় চিরকাল থেকেই যাবে অনিমেষ, মাধবীলতা, অর্জুনরা।