যে অধিনায়ক দেশকে তাঁর রক্ত-ঘামের বিনিময়ে এনে দিয়েছেন শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা, তাঁকে প্রণাম করতে দ্বিধা কীসের! দ্বিধা তাই করেননি অরিজিৎ। বরং নানা বেখাপ্পা দৃষ্টান্তের ভিতর দাঁড়িয়ে অরিজিৎ যেন বুঝিয়ে দিলেন, সম্মান দেওয়ার মন ও মানুষ আজও একেবারে মিলিয়ে যায়নি। আর গোটা দেশ জানল, যোগ্যতমের সামনে মাথা হেঁট করলে কারও সম্মান ক্ষুণ্ণ হয় না। জানল, নামে নয়, প্রণামেই বড় হয়ে ওঠে মানুষ। আপনি আচরি ধর্ম সে-কথাই শেখালেন অরিজিৎ সিং।
তিনি এলেন, গাইলেন, জয়ও করলেন। জয় করলেন অসংখ্য মানুষের হৃদয়। তবে তাঁর গানে শুধু নয়, মানুষের মন জয় করলেন তাঁর অন্য এবং অনন্য ব্যবহারে। দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অধিনায়কের পা ছুঁয়ে যখন প্রণাম করলেন দেশের এই সময়ের সেরা সংগীতশিল্পী- ভারতবর্ষ যেন পেয়ে গেল এই সময়ের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞাপন। তিনি অরিজিৎ সিং। যিনি কুণ্ঠাহীন হয়ে লক্ষ দর্শকের সামনে প্রণাম করেছেন মহেন্দ্র সিং ধোনিকে। ব্যক্তি-আক্রমণে জর্জর, অন্যকে ছোট করার অসুখে আক্রান্ত এই সময়ে অরিজিতের প্রণাম যেন হয়ে উঠল সার্থক শুশ্রূষা।
আরও শুনুন: অযথা বিতর্ক জাগাননি, ভালবেসে জাতীয় মঞ্চে গাইছেন বাংলা গান, শ্রোতারা বুঁদ অরিজিৎ ম্যাজিকে
সন্দেহাতীত ভাবেই, অরিজিৎ এই সময়ে দেশের সেরা সংগীতশিল্পী। সংগীতবিদ্যায় পারদর্শী হয়তো অনেকেই হয়ে ওঠেন। তাঁদের শিল্পকৃতি নিশ্চিতই সম্মান ও সম্ভ্রমের। তবে সব কিছু ছাপিয়েও যেন থেকে যায় অন্য একটা এক্স-ফ্যাক্টর, যার দরুন এক-একটা প্রজন্ম সূচিত হয়ে যায় এক-একজনের নামে। সকলেই নয়, কেউ কেউ তাই হয়ে উঠতে পারেন প্রজন্মের ইশতেহার। এই প্রজন্মের কাছে অরিজিৎ সিং হয়ে উঠেছেন সেই নাম। শুধু তাঁর সংগীতে নয়, তাঁর ব্যক্তিত্বেও। তাঁর প্রমাণ আর-একবার পাওয়া গেল, যখন চলতি আইপিল-এর বর্ণাঢ্য উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মন্দিরা বেদী তাঁর নাম ঘোষণা করলেন। সোল্লাসে ফেটে পড়ল গোটা নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম। আর হবে না-ই বা কেন! যাঁর অনুষ্ঠান দেখতে যাওয়ার সুযোগ সহজে মেলে না, খেলার মাঠে তাঁর গান শুনতে পাওয়ার সৌভাগ্যে স্বাভাবিক ভাবেই আনন্দিত হয়েছিলেন উপস্থিত সকলেই। তারপর তো এলেন, দেখলেন… তবে জয় করলেন শুধু গান গেয়ে নয়, তাঁর ব্যতিক্রমী ব্যবহারেই।
আরও শুনুন: সুমন যেন অমোঘ সংক্রমণ, বাঙালিকে আধুনিক উচ্চারণে বলতে শেখালেন ‘তোমাকে চাই’
একটার পর একটা গান গাইছিলেন অরিজিৎ। প্রত্যেকটি গানই জনপ্রিয়। ক্যামেরা যখন স্টেডিয়াম ঘুরে দেখছিল, দেখা গেল, সকলেই উদ্বেল তাঁর সংগীতে। সকলেই সুরে সুর মেলাচ্ছেন। পাশাপাশি ধরা পড়ল আর-একটা ছবিও। হাতে হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে তখন কেবল একজনেরই নাম। তিনি মহেন্দ্র সিং ধোনি! কে বলবে, মানুষটা প্রায় দু-বছর হল জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়েছেন। ক্রিকেটের মহাযজ্ঞে যে তাঁকে তেমন দেখা যায়, তা তো নয়। বরং নিজেকে অন্তরালে রাখতেই ভালবাসেন তিনি। তবু দেশকে, দেশের ক্রিকেটকে যে উচ্চতায় উন্নীত করেছেন তিনি, তা কে ভুলতে পারে! আর তাই আইপিএল-এ তাঁকে মাঠে দেখা যাবে, এ লোভ যেন সামলানো দায়। যত মানুষ স্টেডিয়ামে, তাঁর থেকেও বেশি মানুষ টেলিভিশনে বা মোবাইলে চোখ রেখেছিলেন ওই একটা মানুষকেই খেলতে দেখবেন বলে। অরিজিৎ-এর গান চলার বেশ কিছুক্ষণ পর ক্যামেরা আবিষ্কার করল তাঁকে, ডাগ আউটে একলা বসে আছেন তিনি। চিরকালের মতোই শান্ত-সমাহিত। অরিজিতের সুরের হিল্লোলে তখন ভাসছে গোটা স্টেডিয়াম।
আরও শুনুন: ‘আপনার ফ্লোরে থাকা দরকার’ জ্বরে কাতর তরুণ মজুমদারের পাশে দাঁড়ালেন স্বয়ং সুচিত্রা
অরিজিতের গানের পর পারফর্ম করলেন তমান্না ভাটিয়া এবং রশ্মিকা মন্দানা। এরপর তিনজনকেই মঞ্চে ডেকে নিলেন মন্দিরা। ডাক পড়ল দুই দলের অধিনায়কেরও। মঞ্চে এলেন ধোনি। সেখানে তখন আছেন বিসিসিআই সভাপতি রজার বিনি, সচিব জয় শাহও। সকলের সঙ্গেই সৌজন্য বিনিময় করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছেন ধোনি। তবে অনুষ্ঠানের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত যেন জন্মের অপেক্ষায় ছিল একেবারে অন্তিমে। ধোনি যখন অরিজিৎ সিং-এর সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করতে গেলেন, তখন নিছক করমর্দন নয়, অরিজিৎ একেবারে তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণামই করলেন। দৃশ্যতই খানিক বিব্রত হলেন ধোনি। কিন্তু যোগ্যের সামনে মাথা নিচু করতে একটুও দ্বিধা করেননি অরিজিৎ। যোগ্যতমকে তাঁর প্রাপ্য সম্মানই দিয়েছেন তিনি। আর যে-সম্মান তিনি দিয়েছেন, তা-ই যেন ফিরে এসেছে তাঁর কাছে। অরিজিতের এই ব্যবহার যেন তাঁকে আর একটু সম্মাননীয় করে তুলেছে এই প্রজন্মের কাছে। গোটা দেশ যেন এই মুহূর্তকে ফ্রিজ শট করে বাঁধিয়ে রাখল বুকের ভিতর। একজন মানুষ খ্যাতি-অর্থ-জনপ্রিয়তার শীর্ষে আহরণ করেও যে নম্র ও বিনয়ী হয়ে থাকতে পারেন, এ কোনও দুরূহ তত্ত্ব নয়। আপনি আচরি ধর্ম সে-কথাই যেন শেখালেন অরিজিৎ, নতুন করে।
এই সময়টার গায়ে কম কালিমা তো লাগছে না। রাজনীতি-শিল্প-সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রেই যেন কুৎসা, ব্যক্তি আক্রমণ বড্ড স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। সময়টার ভিতর যেন অপ্রত্যাশিত ঔদ্ধত্যের বাস, যার কোনও ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, অন্যকে ছোট করার কুৎসিত নেশা যেন সকলকে পেয়ে বসেছে। অকারণ ঔদ্ধত্যের উদযাপনকে যেন বেশ আপন ভেবেই বুকে টেনে নিয়েছে এই সময়। তাঁর সমাজতাত্ত্বিক কী কারণ থাকতে পারে, তা নয় বিশ্লেষণ করবেন বিশেষজ্ঞরা। তবে তাঁর ভিতরে অরিজিতের এই প্রণাম যেন দেখিয়ে দিল, ওই দুর্বিনীত পৃথিবীটাই একমাত্র সত্য নয়। কেননা, এই পৃথিবীই জানে, মতামতের ভিন্নতা থাকলেও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটা কখনই হারিয়ে যেতে পারে না। সৌজন্য ও শ্রদ্ধার স্থান সবার উপরে। এই পরিসরের সাক্ষী তো আগেও থেকেছি আমরা। দেখেছি, দুই গুণী মানুষ কোনও কারণে হয়তো বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছেন, তবু তাঁদের সৌজন্যে টান পড়েনি। বাঙালির সংস্কৃতিতেও আছে এই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পারস্পরিক মতান্তরকে কখনোই মনান্তরের জায়গায় নিয়ে যাননি সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেন। আবার, সংগঠনের নিরিখে মতপার্থক্য থাকলেও অগ্রজ উত্তম কুমারকে প্রণাম করতে দ্বিধা করেননি বাঙালির আর এক আইকন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আসলে মতপার্থক্য বড় ব্যাপার নয়। মানুষ হিসাবে যে যোগ্যকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে হয়, এইসব ঘটনা যেন আমাদের সে-শিক্ষাই দেয়। অরিজিৎ এই ঘরানারই তো উত্তরসূরি। যে অধিনায়ক দেশকে তাঁর রক্ত-ঘামের বিনিময়ে এনে দিয়েছেন শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা, তাঁকে প্রণাম করতে দ্বিধা কীসের! দ্বিধা তাই করেননি অরিজিৎ। বরং নানা বেখাপ্পা দৃষ্টান্তের ভিতর দাঁড়িয়ে অরিজিৎ যেন বুঝিয়ে দিলেন, সম্মান দেওয়ার মন ও মানুষ আজও একেবারে মিলিয়ে যায়নি। আর গোটা দেশ জানল, যোগ্যতমের সামনে মাথা হেঁট করলে কারও সম্মান ক্ষুণ্ণ হয় না। জানল, নামে নয়, প্রণামেই বড় হয়ে ওঠে মানুষ। আপনি আচরি ধর্ম সে-কথাই শেখালেন অরিজিৎ সিং।