তাঁর আরাধনা করলে কখনও অন্নাভাব হয় না। স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব তাঁর সামনে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সেই রত্নালংকার ভূষিতা ত্রিনয়নী দেবী অন্নপূর্ণার পুজো প্রথম শুরু হয়েছিল কাশীধামে। তবে বাংলাতেও এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একাধিক আখ্যান। আসুন শুনে নিই, দেবীর মাহাত্ম্যকথা।
দেবী দুর্গার আরেক রূপ অন্নপূর্ণা। তবে দেবী অপেক্ষা তাঁর প্রতি ‘মাতা’ সম্বোধনই অধিক প্রচলিত। কারণ তিনি সন্তানের ক্ষুধা সহ্য করতে পারেন না। তাই তো তাঁর স্মরণ নিলে কাউকে অভুক্ত থাকতে হয় না। দেবী মূর্তিতেই দেখা যায়, মহাদেব ভিক্ষার ঝুলি হাতে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। স্বয়ং মহাকাল যার কাছে ভিক্ষা চাইতে পারেন, ত্রিভূবনের সকলে তো তাঁর কাছেই মাথা নত করবে।
আরও শুনুন: রাম নাম লেখা পাথরও ভাসে জলে, রামের প্রতি ভক্তিতেই জন্ম অজস্র জনশ্রুতির
ধ্যান মন্ত্র অনুসারে, দেবী দ্বিভুজা। গাত্রবর্ণ ইষৎ রক্তাভ। স্নিগ্ধ ত্রিনয়ন। যেন জগতের সমস্ত প্রাণীকুলকে তিনি আশ্বস্ত করছেন, ‘কেউ অন্নের চিন্তা করিস না’। তাইতো তাঁর ওপর নাম অন্নদা। তবে পুরাণ মতে, তাঁর আবির্ভাব উত্তরপ্রদেশের কাশীধামে। কাশীশ্বরি নামেই সেখানে তিনি খ্যাত। বিশ্বনাথ মন্দির চত্বরেই তাঁর মন্দির। সেখানে নিত্যপূজা পায় দেবীর রত্নখচিত স্বর্ণমূর্তি। এই কাশীধামে দেবীর আবির্ভাব নিয়ে এক পৌরাণিক আখ্যান রয়েছে। পুরাণমতে ভোলা মহেশ্বরকে শিক্ষা দিতেই অন্নপূর্ণা রূপে আবির্ভাব হয় দেবী দুর্গার। লোককাহিনি অনুসারে, শিব যোগীরাজ হলেও, আদতে তিনি একজন ভিক্ষুক। অন্যান্য দেবতাদের তুলনায় তাঁর ঐশ্বর্য্য নেই বললেই চলে। এদিকে তাঁর ঘরনি রাজকণ্যা গৌরী। এমন স্বামী যাঁর কপালে জুটেছে, তাঁর ভাঁড়ার শূণ্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই নিয়ে শিব-দুর্গার অহরহ কলহ লেগে থাকত। এমনই একদিন প্রবল বিবাদের জেরে দুর্গা ভয়ানক চটে গেলেন। সখীদের পরামর্শে ঠিক করলেন শিবকে জব্দ করতে হবে। সেই মতো জগতের সব অন্ন হরণ করে কাশীতে এসে আশ্রয় নিলেন দেবী। এদিকে জগতে কারও ঘরে অন্ন নেই। শিবও তাই ভিক্ষা চেয়ে চেয়ে ক্লান্ত। একইসঙ্গে খিদের চোটেও নাকাল। অসহায় শিব গেলেন দেবী লক্ষ্মীর কাছে। দেবী পদ্মা তাঁকে পরামর্শ দিলেন কাশীধামে যাওয়ার। সেখানে গিয়েই দেবী অন্নপূর্ণার দেখা পেলেন শিব। ভিক্ষার পাত্র হাতে তাঁর সামনে দাঁড়ালেন। দেবীর দান করা অন্ন খেয়ে পরম তৃপ্তি পেলেন দেবাদিদেব। এরপরই কাশীতে প্রতিষ্ঠা হল অন্নদাত্রী দেবী অন্নপূর্ণার মন্দির। দেবীর মুর্তিতেও দেখা যায়, শিব ভিক্ষার পাত্র হাতে দাঁড়িয়ে, এবং খাবার ভর্তি হাঁড়ি থেকে দেবাদিদেবকে ভিক্ষা দিচ্ছেন তিনি। জানা যায়, চৈত্র মাসের শুক্লাষ্টমী তিথিতে সর্বপ্রথম দেবীর পুজো হয়েছিল। সেই থেকে এই দিনটিতেই মহা সমারোহে দেবী অন্নপূর্ণার পুজো হয় গোটা দেশে।
আরও শুনুন: শস্যের দেবী মা লক্ষ্মী, হিন্দুদের মতোই তাঁর উপাসনা করেন অন্য ধর্মের মানুষও
তবে বাংলায় এই পুজোর প্রচলন করেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এক পূর্বসুরি। যদিও মহারাজা কৃষঞ্চন্দ্র এক বিশেষ ঘটনার পর ধুমধাম করে দেবীর পুজো করতেন। শোনা যায়, খাজনা দিতে না পেরে তিনি একবার তৎকালীন বাংলার নবাবের কাছে বন্দী হয়েছিলেন। তখন দেবী অন্নপূর্ণার কৃপাতেই মুক্তি পেয়েছিলেন তিনি। তারপর রাজ্যে ফিরে ধুমধাম করে অন্নপূর্ণা পুজো করেছিলেন। দেবী অন্নপূর্ণার উল্লেখ বাংলা সাহিত্যেও খুবই স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। একদিকে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের তন্ত্রসার গ্রন্থে অন্নপূর্ণা পুজোর বিশদ বিবরণ রয়েছে। আবার দেবীকে ‘অন্নদা’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে, রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রচনা করেছিলেন ‘অন্নদামঙ্গলকাব্য’। ঈশ্বরী পাটনী ও দেবী অন্নপূর্নার কথোপথন যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে কাশীতে অন্নপূর্ণা পুজো শুরুর আগেও দেবীর এই বিশেষ রুপের পুজো ধরাধামে হত। সেক্ষেত্রে মূর্তি হয়তো ছিল না তবে গ্রামবাংলায় তিনি ছিলেন শস্যের দেবী। এখনও নতুন ধান উঠলে নবান্ন উৎসব পালন করা হয় অনেক জায়গায়। সেখানেও দেবী নবান্ন লক্ষ্মীর সঙ্গে অন্নপূর্ণার পুজো হয়। যদিও চৈত্র মাসের অন্নপূর্ণা পুজোই দেবীর প্রধান পুজো। এইদিনে বাংলা সহ সারা দেশের মানুষ ভক্তিভরে তাঁর অর্চনা করেন। স্থান ,কাল, পাত্র বিশেষে পুজোর রকসকম আলাদা হলেও, ভক্তির সূত্রে বাঁধা থাকেন সকলেই।