যে সমাজের রাশ ধরা আছে পুরুষের হাতেই, সেখানে নারীর প্রতি অবদমনের এক প্রবণতা জারি থাকবেই। এ দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এ দেশেই রয়েছে এর উলটো ছবিটাও। যেখানে নিজেদের ব্যক্তিত্বের জোরেই সম্মান আদায় করে নিয়েছে মেয়েরা। আর সেই নারীদের সম্মান জানাতে ভোলেনি ইতিহাসও। তারই এক স্পষ্ট ছবি ধরা পড়ে ভারতীয় মুদ্রায়। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
ভারতীয় মুদ্রা যেমন বীরপুরুষদের সম্মান জানিয়েছে, তেমনই কুর্নিশ জানিয়েছে বীরাঙ্গনাদেরও। দেশের মুদ্রায় উঠে এসেছে এমন কিছু নারীদের কথা, পিতৃতন্ত্রের পাথর ফাটিয়ে যাঁরা উঠে এসেছেন নিজের জোরেই। তাঁদের সামনেও ছিল বাধার লক্ষ্মণরেখা। সেইসব প্রতিকূলতা কাটাতে কেউ বা লড়াই চালিয়ে গেছেন রাজত্ব, সিংহাসন বাঁচাতে, আবার কেউ শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কেউ আবার শিল্পীমহলে নিজগুণে জায়গা করে নিয়েছেন। আর এভাবেই সেইসব নারীরা সমাজে তাঁদের জায়গা চিহ্নিত করে দিয়ে গিয়েছেন। শুনে নেওয়া যাক সেরকমই কয়েকজন নারীর কথা।
আরও শুনুন: Superwoman: মেয়েরাও ছেলেদের মতোই পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারে, বার্তা ‘ভাতের হোটেল’-খ্যাত নন্দিনীর
এই নারীদের মধ্যে অন্যতম কাশ্মীরের দিদ্দা রানি। কাশ্মীরের রাজা ক্ষেমাগুপ্তের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। স্বামী অকালে মারা গেলে নাবালক পুত্রের হয়ে সিংহাসনের দায়িত্ব নেন। সেটা ৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ। টানা ১০০৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কাশ্মীরে তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। সিংহাসন বাঁচাতে তিনি নাকি তাঁর ছেলে, এমনকি নাতিদেরও খুন করতে পিছপা হননি। সেসময় মুদ্রা এখনকার মতো নির্দিষ্ট আকার না পেলেও বিনিময়ের জন্য ধাতু বা কাঠের একরকম পাত প্রচলিত ছিল। যার নাম ‘ক্রুড কয়েন’। রানি দিদ্দার সময়ে দেখা যায়, সেইসব মুদ্রায় খোদাই করা রয়েছে একজন নারীর প্রতিকৃতি। সেগুলিকেই দিদ্দা রানি কয়েন বলা হত। পরবর্তীকালে তাঁর বংশের সকল শাসকই সেই কয়েন ব্যবহার করতেন।
আরও শুনুন: Superwoman: নারী সফল হলে পরিবারের পুরুষরা খুশিই হয়, সাফল্যের সহজপাঠ শেখালেন অদিতি
কালের হিসেবে এরপর আসে রাজিয়া সুলতানা-র নাম। সুলতান ইলতুৎমিস, তাঁর কন্যা রাজিয়াকে সিংহাসনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তাঁর ক্ষুরধার রাজনৈতিক বুদ্ধি ও যুদ্ধবিদ্যায় দক্ষতার জন্য। সেদিক থেকে দেখতে গেলে রাজিয়াই ভারতবর্ষের প্রথম সুলতানা। তাঁর শাসনকালেও তাঁর নামে মুদ্রা চালু ছিল। আবার মুঘল আমলে সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রায় সমান মর্যাদা ছিল তাঁর প্রিয়তমা বেগম নূরজাহানের। তাঁর নামেও সেকালে মুদ্রা ছিল বলেই জানা যায়। পরবর্তীকালে ত্রিপুরার মুদ্রাতেও, রাজাদের সঙ্গে রানির নাম লেখা থাকত।
স্বাধীন ভারতে প্রথম কোনও নারী শাসকের প্রতিকৃতি দেওয়া মুদ্রা প্রকাশ পায় ১৯৮৫ সালে। ১৯৮৪ সালে নিহত হন ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তাঁকে সম্মান জানাতেই তাঁর প্রতিকৃতি-সহ একটি ৫ টাকা ও একটি ৫০ পয়সার স্মারক মুদ্রা প্রকাশ করা হয়েছিল সরকারের তরফে। আবার ২০০৭ সালে, সিপাহী বিদ্রোহের দেড়শো বছর পূর্তিতে, স্বাধীনতার প্রথম লড়াইয়ের স্মারক মুদ্রা প্রকাশ করেছিল ভারত সরকার। ইংরেজ সেনার বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই করা ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাইয়ের প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছিল সেই মুদ্রায়। এদিকে ব্রিটিশশাসিত ভারতে আদিবাসী বিদ্রোহী নেত্রী ছিলেন, গাইদিন লিউ।পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু তাকে ডাকতেন রানি বলে। তাই মুখে মুখে তিনি হয়ে গেলেন রানি গাইদেন লিউ। সেই নেত্রীর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ২০১৫ সালে রানির স্মারক মুদ্রা প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু তা বেশিদিন চলেনি। শুধু কিছু মুদ্রা সংগ্রাহকের ঠিকানায় খুঁজলে পাওয়া যেতে পারে।
২০২০ সালে ভারত সরকারের তরফে গোয়ালিয়রের রাজমাতা বিজয়ারাজে সিন্দিয়ার জন্মশতবর্ষের স্মারক মুদ্রা প্রকাশ করা হয়। এটি একটি ১০০ টাকার মুদ্রা। তবে বিনিময়যোগ্য নয়।
এ দেশের মুদ্রায় যেসব নারী স্থান পেয়েছেন, তাঁরা সকলেই যে কেবল শাসক ছিলেন, তা কিন্তু নয়। যেমন ২০১৪ সালে, মালিকা-এ-গজল, বেগম আখতারের প্রতিকৃতি সমেত, ৫ টাকার স্মারক মুদ্রা প্রকাশ করা হয়েছিল। আবার ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় দক্ষিণী ঘরানার রাগসংগীত শিল্পী এম এস শুভলক্ষ্মীর ছবি-সহ মুদ্রা।
ভারতবর্ষ মাতৃপূজার দেশ। আর তাই, বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন কালে দেশের ভূমিকন্যাদের এমনই অভিনব উপায়ে সম্মান জানিয়েছে ভারত।