আমরা ভুলে যাই মাঝে মাঝে যে, যাঁদের সঙ্গে সেলফি তুলতে চাইছি, তাঁরাও মানুষ, তাঁদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা আছে। ‘পাবলিক ফিগার’ মানেই কিন্তু তাঁরা ‘পাবলিক প্রপার্টি’ হয়ে যান না। সেলফির অসুখ যেন মরিয়া করে তুলেছে মানুষকে, আলোচনায় শঙ্খ বিশ্বাস।
সম্প্রতি চেম্বুরে একটি শো করতে গিয়েছিলেন সোনু নিগাম। আর সেখানেই রীতিমত হেনস্তার শিকার হতে হল তাঁর মতো এরকম একজন জেনেরাশনাল আর্টিস্ট-কে। গায়কের অভিযোগ, বিধায়কের ছেলে তাঁর চুল ধরে টানেন, তাঁর নিরাপত্তারক্ষী, ম্যানেজারকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। এমনকি, তাঁর সঙ্গে অভব্য আচরণ করেন। অন্য দিকে, ছেলের হয়ে ব্যাট ধরে বিধায়ক বাবার সাফাই পুরো ঘটনাটাই অনিচ্ছাকৃত। তাঁর ছেলে কাউকে ধাক্কা দিতে চায়নি। সোনু নিগাম স্টেজ থেকে নেমে যাওয়ার সময় সেলফি তুলতে গিয়েছিল। যা হয়েছে খুবই দুঃখজনক, তবে এমনিতে তার ছেলে নাকি খুবই নম্র, শান্ত। তাহলে এখন প্রশ্ন যে একটা সামান্য সেলফির জন্য এরকম নম্র শান্ত ছেলেটি এরকম বিগড়ে গেল কেন?
আরও শুনুন: Audio Blog: প্রিয় অভিনেতা মানেই প্রিয় মানুষ নন, নওয়াজউদ্দিনের ঘটনা দিচ্ছে সেই ইঙ্গিত
সেলফি- এই শব্দটার সঙ্গে এখন পরিচত নন এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর। এমনকি ৪-৫ বছরের ছেলে-মেয়েদেরও আজকাল দেখা যাচ্ছে তাদের মা বাবার মোবাইলে সেলফি তুলতে। দিন দিন এই সেলফি তোলা এমন এক অবসেশন-এর পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যে, মানুষ আর কিছু করতে ভুলুক আর না ভুলুক, সেলফি তুলতে ভোলে না। সেলফি তুলে তার সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে পোস্ট না করতে পারলে যেন রাতের ঘুমই হবে না। কোথাও খেতে গিয়ে সেলফি, ঘুরতে গিয়ে সেলফি, কোনও নতুন জিনিস কিনে সেটির সঙ্গে সেলফি, শুধু সেলফি সেলফি আর সেলফি। বিশ্বাস না হলে যান না আপনার সোশ্যাল মিডিয়া ফিড-টা একটু দেখে আসুন, দেখবেন, প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৬ জনের প্রোফাইলে ডিসপ্লে পিক হল ওই সেলফি। ওই যে একটু আগেই বলছিলাম না সেলফি তোলা এখন রীতিমতো অবসেশনের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে ! আর এর কুফলও কিন্তু দেখা যাচ্ছে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে।
আমরা যারা সাধারণ মানুষ তাদের যে সেলিব্রিটিদের প্রতি দুর্বলতা থাকে এটা সবারই জানা। আর এই দুর্বলতার দরুন সেরকম কাউকে ধারে কাছে দেখলেই আমরা তাঁদের সঙ্গে সেলফি তোলার জন্য ছুটি। সেই সেলফি পোস্ট করতে পারলেই তো আমাদের স্টেটাস একটু বাড়বে, প্রোফাইলের রিচ বাড়বে, প্রচুর লাইক আসবে তাই না? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের প্রিয় সেলিব্রিটিরা হাসিমুখেই আমাদের সব আবদার মেটান। আর যদি কখনও তাঁরা সেলফি তুলতে অস্বীকার করেন, তখন? তখন কিন্তু আমাদের খুব রাগ হয়। মনে হয় সামান্য একটা সেলফি তুলতেই তো চাইলাম ! তাতেই এত্ত দেমাক? কী ভাবে কি নিজেকে? আমরা ভেবে নিই সেলফি তোলা যেন অনেকটা আমাদের অধিকারের মধ্যে পড়ে। আর আমাদের এই ভাবনা থেকেই কখনও-সখনও জন্ম হয় বেশ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার।
আরও শুনুন: লতা মঙ্গেশকরকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, সৌজন্যের প্রশ্নে পাকিস্তানকে তুলোধোনা জাভেদ আখতারের
ঠিক যেমনটা ঘটেছে সোনু নিগমের সঙ্গে। সম্প্রতি চেম্বুর বনাম একটু জায়গায় শো ছিল তাঁর, আর সেখানেই অনুষ্ঠানের শেষে শুরু হয় সেলফি তোলা নিয়ে অশান্তি। অভিযোগ, সেলফি তুলতে গিয়েই নাকি সোনুর উপর চড়াও হন স্থানীয় বিধায়ক প্রকাশ ফাটরেপেকরের ছেলে। সোনুর নিরাপত্তারক্ষী আর ম্যানেজারকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় সেই ছেলে, এমনকী সোনুর চুল ধরেও টানেন! ধাক্কা এতটাই জোরে ছিল যে সোনুর বন্ধু প্রায় সাত ফুট নিচে পড়ে যান। ফলে বড়সড়ো কোনও দুর্ঘটনা ঘটতেই পারত। ঘটনার জল এতদূর গোড়ায় যে চেম্বুর থানায় অভিযোগ দায়ের করতে বাধ্য হন সোনু নিগাম!
আবার এই তো গত সপ্তাহে সন্তাক্রুজের এক বিলাসবহুল রেস্তরাঁয় কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে ডিনারে গিয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের পরিচিত মুখ পৃথ্বী শ। আর সেখানেই ক্রিকেটারের সঙ্গে সেলফির আবদার করেন বেশ কিছু অনুরাগী। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের আবদার হাসি মুখেই মেটান পৃথ্বী। তবে তার পরেও একের পর এক আবদার আসতে থাকায় কিছুটা বিরক্ত হয়ে নিজস্বী তুলতে অস্বীকার করেন তিনি। আর তাতেই বাধে গণ্ডগোল। রেস্তরাঁর ম্যানেজার ওই অনুরাগীদের বাইরে বার করে দিলে রাগের চোটে বেসবল ব্যাট দিয়ে মেরে পৃথ্বীর গাড়ির কাচ ভেঙে দেন তাঁরা। সেই ঘটনার জল ও গড়ায় থানা – আদালত পর্যন্ত। এখানেও কিন্তু কারণ ওই সেলফি।
আসলে আমাদের ধৈর্য দিন দিন কমে যাচ্ছে। আর ওই যে সেলফি তোলা আমাদের অধিকার- এই বোধ আমাদের এই সব অপ্রীতিকর ঘটনার দিকে আরও ঠেলে দিচ্ছে। আমরা ভুলে যাই মাঝে মাঝে যে, যাঁদের সঙ্গে
সেলফি তুলতে চাইছি, তাঁরাও মানুষ, তাঁদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা আছে। ‘পাবলিক ফিগার’ মানেই কিন্তু তাঁরা ‘পাবলিক প্রপার্টি’ হয়ে যান না। ঠিক এই ইস্যুতেই জয়া বচ্চন তাঁর নাতনি নব্যা নভেলি নন্দার পডকাস্টে জানিয়েছিলেন যে, যাঁরা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলান, তাঁদের তিনি একদম পছন্দ করেন না। তিনি বলেন, ‘যদি লোকে আমার রেগে যাওয়ার ভিডিও ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম আর ট্যুইটারে পোস্ট করে আয় করতে চায়, তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না… তুমি আমার ব্যক্তিগত পরিসরে নাক গলাচ্ছ, আমি যখন হেঁটে কোথাও যাচ্ছি আমার ছবি তুলছ, কেন? আমি কি মানুষ নই?’
সুতরাং সেলফি আপনি তুলুন না তাতে কোনো সমস্যা নেই যতক্ষণ না তা অন্যের বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠছে। নিজে ভালো থাকুন অন্যকেও ভালো থাকতে দিন। প্রত্যেকটা মানুষের নিজের পছন্দ-অপছন্দ আছে সেটাকে সম্মান দিন। তাহলে আশা করি ওই সামান্য সেলফি কে কেন্দ্র করে আর এই রকম অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন আমাদের হতে হবে না।