তিনি শ্মশানচারী। কখনও ভিক্ষুকরূপে দেবী অন্নপূর্ণার পাশে। আবার কখনও শবরূপে মহামায়ার পদতলে, তাঁর অবস্থান। খুব অল্পেতেই তিনি সন্তুষ্ট। কোনও উপাচার ছাড়া, স্রেফ ভক্তিভরে ডাকলেই তিনি সাড়া দেন। এমনই ভোলা মন তাঁর। তবু শুধুমাত্র তাঁকে উদ্দেশ্য করেও প্রচলিত রয়েছে এক ব্রত। যা নিষ্ঠাভরে পালন করলে মৃত্যুর পর ঠাঁই মেলে শিবলোকে। আসুন, শুনে নিই শিবরাত্রি ব্রতের মাহাত্ম্যকথা।
গ্রামবাংলার অধিকাংশ ব্রতের নেপথ্যেই দুটি ধারণা প্রচলিত থাকে। একটি অবশ্যই লৌকিক উপাখান। আর অন্যটি পৌরাণিক ব্যাখ্যা। তবে শিবকে বরাবরই আদি গুরু হিসেবেই অর্চনা করতেন মুনি ঋষিরা। তাই তাঁর জন্য আলাদা করে কোনও ব্রতের উল্লেখ পুরাণে মেলে না বললেই চলে। তাহলে সাধারণ মানুষ শিবের পুজো করবেন কীভাবে? সে প্রশ্নের উত্তরে, স্বয়ং দেবাদিদেব শিবরাত্রি ব্রতের কথা উল্লেখ করেন। সেই ব্যাখ্যাটিকেই শিবরাত্রি ব্রতের পৌরাণিক উপাখ্যান বলা যায়। আর সেখানেই উঠে আসে শিব-পার্বতীর একান্ত কথোপকথন।
আরও শুনুন: কোল আলো করে আছে ছোট্ট শিশু, অন্য রূপেও পূজিতা মা কালী
মহাদেবকে তাঁর পত্নী পার্বতী একবার প্রশ্ন করেন, কোন ব্রত করলে তিনি তুষ্ট হবেন? কারণ তিনি তো ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ সমস্ত কিছুরই ঊর্ধ্বে। তাঁর পুজোর উপকরণই বা কী হতে পারে? দেবী পার্বতীর কথা শুনে শিব বলেন, ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথি তাঁর অত্যন্ত প্রিয়। এইদিনে কেউ যদি উপবাস থেকে ভক্তিভরে তাঁর পুজো করে, তাহলে অত্যন্ত খুশি হন মহেশ্বর। উপাচার বলতে কেবলই একটা বেলপাতা আর দেবাদিদেবের প্রিয় ফল বেল। ব্যস, এইটুকু উপাচারেই পরম সন্তুষ্ট হন আশুতোষ। ব্রতের নিয়ম অনুযায়ী, শিব চতুর্দশীর দিন সম্পূর্ণ উপোস থেকে বেলপাতা দিয়ে শিবের পুজো করতে হয়। পরের দিন কোনও ব্রাহ্মণকে ভোজন করিয়ে ব্রত সম্পূর্ণ হয়। বলা হয়, এই প্রীতিকর ব্রত পালন করলে তপস্যা ও যজ্ঞের পুণ্যও লাভ হয়।
তবে এ তো গেল শিবরাত্রির পৌরাণিক ব্যাখ্যা। মর্তে, এহেন ব্রতের প্রচলন হয় কোনও বিশেষ কাহিনির মাধ্যমে। শিবরাত্রি ব্রতও তার ব্যতিক্রম নয়।
শোনা যায়, কোনও এককালে বারাণসীতে এক ভয়ংকর ব্যাধ বাস করত। যে কোনও হিংস্র জন্তুকেই অনায়াসে ঘায়েল করে ফেলত এই ব্যাধ। শিকারের এমন কোনও অস্ত্র ছিল না, যা তার কাছে নেই। প্রায় প্রতিদিনই শিকার করতে যেত সে। জঙ্গল থেকে পশু পাখি মেরে কিছুটা বাজারে বিক্রি করত। বাকিটা উদরস্থ করত নিজেই। এরকমই একদিন জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে অন্যদিনের তুলনায় অনেক বেশি পশু হত্যা করে ফেলে ওই ব্যাধ। এদিকে সারাদিন শিকার করে যথেষ্ট ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে। ঠিক করে, পথেই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেবে। কিন্তু অতিরিক্ত ক্লান্তির জেরে কখন যে চোখে ঘুম চলে আসে, তা সে টেরও পায় না। ঘুম ভাঙার পর ব্যাধ বুঝতে পারে সূর্য অস্ত গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জঙ্গল দুর্ভেদ্য অন্ধকারে ঢেকে যাবে। এই সময় মাটিতে থাকা একেবারেই নিরাপদ নয়। তার ওপর সঙ্গে এত মৃত পশু রয়েছে। এদের মাংসের গন্ধে যে কোনও মুহূর্তে হিংস্র পশুরা চলে আসতে পারে। উপায় না দেখে সামনে থাকা একটা গাছেই সে উঠে পড়ে। তারপর একটা ডালে মৃত পশুগুলিকে ঝুলিয়ে রেখে ওখানেই রাতটুকু কাটিয়ে দেয় সে। পরের দিন ভোরে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয় ব্যাধ। যেতে যেতেই ঠিক করে ফেলে, কদিন আর শিকারে বেরোবে না। যা শিকার হয়েছে এতেই কয়েকদিন অনায়াসে কেটে যাবে। বাড়ি ফিরে তার জন্য দ্রুত খাবার সাজানোর নির্দেশ দিয়ে স্নানে যায় ব্যাধ। একটা গোটা দিন না খেয়ে ব্যাধের পেটে তখন রাক্ষুসে খিদে। কিন্তু খেতে বসতেই দেখা দেয় আরেক বিপত্তি। কোথা থেকে এক ভিক্ষুক ব্রাহ্মণ এসে তার কাছে অন্ন ভিক্ষা চায়। পশুদের হত্যা করার ব্যাপারে সে যতই নিষ্ঠুর হোক না কেন, তার স্বভাবে দয়াধর্ম ছিল। তাই ক্ষুধার্তের ডাকে সাড়া দিয়ে সে খাওয়ার আসন ছেড়ে উঠে পড়ে। ওই ব্রাহ্মণের খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়।
আরও শুনুন: পৌষ মাসে মুলো দিয়ে মা কালীর পুজো দেওয়া হয়, নেপথ্যে কোন কারণ?
কালক্রমে ব্যাধের আয়ু শেষ হয়। কিন্তু মৃত্যুর পরই দেখা যায়, তার আত্মা নিয়ে কার্যত টানাটানি চলছে। একদিকে ব্যাধের আত্মাকে যমলোকে নিয়ে যেতে যমদূতেরা হাজির। অন্যদিকে হাজির শিবের চ্যালারাও। এতদূর শুনে অনেকেরই মনে হতে পারে শিবের চ্যালারা হঠাৎ কোথা থেকে এল? আসলে এখানেই লুকিয়ে শিবরাত্রি ব্রতের মাহাত্ম্য। সেদিন নিজের অজান্তেই ব্যাধ এই ব্রত পালন করে ফেলেছিল। একে তো সারাদিন উপোস। তারপর ব্যাধ যে গাছে রাত কাটিয়েছিল সেটা বেলগাছই ছিল। রাতের বেলা নড়াচড়া করায় সেই গাছ থেকে একটা শিশিরে ভেজা বেলপাতা খসে গাছের নীচে থাকা শিবলিঙ্গের মাথায় পড়ে। আবার পরের দিন নিজে না খেয়ে ব্রাহ্মণ ভোজন পর্যন্ত করায় ওই ব্যাধ। এর ফলেই সে শিবরাত্রি ব্রতের পুণ্যফল লাভ করে। যার জন্য মৃত্যুর পর তাকে শিবের কাছে নিয়ে যেতে এসেছে শিবের চ্যালারা। ব্রতের এমনই মাহাত্ম্য, স্বয়ং যমও তার সামনে মাথা নত করতে বাধ্য হয়। ব্যাধের আত্মা ঠাঁই পায় দেবাদিদেবের চরণে। এরপর ধীরে ধীরে মর্তে এই ব্রতের কথা ছড়িয়ে পড়ে।