বয়কটের হাওয়া প্রায় বেসামাল করে তুলেছিল বলিউডকে। বড় বড় তারকারা সেই ঝড়ের সামনে দাঁড়াতে পারেননি। ব্যতিক্রম শাহরুখ খান। তাঁর ছবি ‘পাঠান’-এর সাফল্য যেন বয়কট প্রবণতার পালটা উত্তর। কিন্তু কোন মন্ত্রে এই ছায়াযুদ্ধে জয়ী হলেন শাহরুখ? আসুন শুনে নিই।
মাধ্যম হিসাবে সিনেমার যে নিজস্ব শক্তি, তার উপর পূর্ণ বিশ্বাস ছিল তাঁর। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যে-সংকীর্ণতা আমাদের গ্রাস করে, বিভাজিত করে, তার উলটো দিকে সিনেমা যে উদার খোলা জানলা হয়ে উঠতে পারে, এমনটাই ছিল তাঁর মত। তিনি শাহরুখ খান। যাঁর সদ্য মুক্তি পাওয়া ছবি ‘পাঠান’ যেন সাম্প্রতিক বয়কট ট্রেন্ডের উদ্দেশে জবাবি চিঠি হয়েই ধরা দিয়েছে।
আরও শুনুন: ‘দ্বেষের দেশ’ ভোলাল ‘পাঠান’, বয়কট-ড্রাগ পেরিয়ে পর্দায় যেন ভারত-জোড়ো শাহরুখের
লড়াইটা অবশ্য সহজ ছিল না। এই তো কিছুদিন আগেই মুক্তি পেয়েছিল আমির খানের ‘লাল সিং চাড্ডা’ ছবিটি। সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র বয়কটের মুখে পরে সে ছবি। বহু আগে এক সাক্ষাৎকারে আমির বলেছিলেন, দেশে অসহিষ্ণুতা ক্রমশ বাড়ছে। সেই মন্তব্যকে হাতিয়ার করে বয়কটের হাওয়া জোরালো হয়। তার প্রভাব পড়ে বক্স অফিসেও। রীতিমতো মুখ থবড়ে পড়ে ছবিটি। আবার আমিরের ছবির প্রশংসা করে বয়কটের মুখে পড়েন হৃতিক রোশনও। ব্যাপারটা ক্রমে এরকম হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, ছবির তারকাদের যেন অদৃশ্য বয়কট গ্যাং-এর সঙ্গে ছায়াযুদ্ধে নামতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বছর পাঁচেকের মাথায় শাহরুখ যখন বড় পর্দায় কামব্যাক করছেন, তখনও শুরু হল এই বয়কট ট্রেন্ড। কিন্তু ঘটনাচক্রে অন্য তারকাদের মতো বয়কটের হাওয়া শাহরুখকে নুইয়ে দিতে পারেনি। বরং এই বয়কটের পৃথিবীর বাইরে যে একটা মস্ত দুনিয়া আছে, তাই-ই প্রমাণ করে দিয়েছেন শাহরুখ। পুরো বিষয়টিকে তিনি যেভাবে সামলেছেন, তা একরকম দৃষ্টান্তই বলা যায়।
প্রথমেই বলতে হয়, সিনেমার শক্তির প্রতি তাঁর পূর্ণ আস্থার কথা। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এসে সে-কথা জানিয়েছিলেন তিনি। তখন ‘পাঠান’ ছবির ‘বেসরম রং’ গানটি নিয়ে তীব্র বিতর্ক চারিদিকে। ‘পাঠান’ বয়কটেরও দাবি উঠেছে। ঠিক সেই সময় এসে শাহরুখ জানিয়েছিলেন, সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের প্রায়শই সংকীর্ণতায় বেঁধে ফেলছে ঠিকই। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন যে, সিনেমার আরও বড় ভূমিকা আছে। তাঁর নিজের ছবি সেই ভূমিকাই পালন করেছে। বয়কটের ছোট সীমানা পেরিয়ে বেঁধে রাখতে পেরেছে বিরাট পৃথিবীকে। অথচ গোড়াতে তো ছবির নাম অর্থাৎ ‘পাঠান’ নামটিই বদলের দাবি উঠেছিল। প্রযোজনা সংস্থা এবং শাহরুখ নিজে এ নিয়ে টুঁ শব্দটি করেননি। যেন তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, জীবনে কখনও এরকম মুহূর্ত আসে, যা ঠিকঠাক নয়। কিন্তু ওই সময়ের তাপ-উত্তাপ সহ্য করেই এগিয়ে যেতে হয়। এগিয়ে যাওয়াটাই আসল কথা। এই মন্ত্রে কাজও হয়েছে। দেখা গেল, কিছুদিন পর এই দাবি ফিকে হয়ে এসেছে। বরং পক্ষ এবং বিপক্ষ- দুই দলের কাছেই ‘পাঠান’ নামটিই স্বীকৃত হয়ে গিয়েছে। এরপর যখন ‘বেসরম রং’ নিয়ে বিতর্ক শুরু হল, তখনও বেশ কায়দা করেই তা সামলেছিলেন কিং খান। দীপিকার পরনের গেরুয়া বিকিনি নিয়ে প্রথমে আপত্তি ওঠে। দাবি তোলা হয়, এই দৃশ্য বদলে ফেলতে হবে। পরে পোশাকের গেরুয়া রং ও গানের কথায় থাকা ‘বেসরম রং’- এই দুয়ের মিশেলেও আপত্তি ওঠে। এটিও বদলে ফেলার দাবি জানানো হয়। এমনকী প্রতিবাদ-বিক্ষোভে শাহরুখ-দীপিকার কুশপুতুলও পোড়ানো হয়। এই পর্বেও স্থৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছিলেন বলিউডের সবথেকে বড় সুপারস্টার। তিনি না কিছু বলেছেন, না তড়িঘড়ি কোনও পদক্ষেপ করেছেন। তাঁর মন্ত্র ছিল, সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কখনও দু-কদম পিছিয়ে আসা ভাল। অকারণ ভয়ের গণ্ডিতে নিজেকে বন্দি করে ফেললে নিজেরই ক্ষতি। শাহরুখ ভয় পাননি, বরং ওই এক কদম পিছিয়ে এসে ভরসা রেখেছিলেন সেন্সর বোর্ডের উপর। বোর্ড পরীক্ষা করে যতটুকু সম্পাদনা করার দরকার তা করেছে তারপর ছাড়প্ত্রও দিয়েছে। দেখা গেল, ছবিতে ‘বেসরম রং’ গানটি আছে, আর দীপিকাকে গেরুয়া বিকিনিতেও দেখা গিয়েছে। অর্থাৎ বয়কটের যা যা ভিত্তি, তা যে ভিত্তিহীন তা নীরব থেকেই বুঝিয়ে দিয়েছেন শাহরুখ। ভরসা রেখেছেন সেই সব প্রতিষ্ঠানের উপর যা সত্যি সত্যিই সিনেমা সংক্রান্ত। সোশ্যাল মিডিয়া মতামত প্রকাশের জায়গা হতে পারে, কিন্তু তা যে সবকিছুকে স্বীকৃতি দিতে পারে না, তা যেন নিজের ব্যবহারে পদে পদেই বুঝিয়ে দিয়েছেন শাহরুখ। অকারণ সংকীর্ণতার ফাঁদে পা দেননি, বিবাদেও জড়াননি। শুধু ভরসা রেখেছিলেন তাঁর এতদিনে তিল তিল করে গড়ে তোলা পৃথিবীর বাসিন্দা অর্থাৎ দর্শকের উপর। দেখা গেল, ভিত্তিহীন বয়কট যত জোরদার হয়েছে, শাহরুখের দর্শক তত এককাট্টা হয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে মজা করে তিনি বলেছিলেন, বয়কট বেশ ভাল রকমের একখানা অজুহাত। ছবি না চললে, ওর ঘাড়েই দোষ চাপিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু সে দোষ চাপানোর কাজ তাঁকে করতে হয়নি। বরং বয়কট ও বিতর্ক শাপে বর হয়েছে তাঁর ক্ষেত্রে। আর এই বয়কটের হাওয়াকে নিজের পালের দিকে ঘুরিয়ে নেওয়ার কাজটি করেছেন শাহরুখ নিজেই। প্ররোচনায় পা না দিয়ে, ভরসা রেখেছেন তাঁর নিজের শক্তির উপর। সিনেমার শক্তি উপর। ফলাফলে দেখা গেল, বয়কট গ্যাং-এর সঙ্গে ছায়াযুদ্ধে জয়ী হয়েছেন কিং খান-ই। এই পুরো পর্বে যে আসল মন্ত্রটি লুকিয়ে ছিল, তা হল আত্মবিশ্বাস। নিজের উপর বিশ্বাস, নিজের কাজের উপর বিশ্বাস থাকলে যে কোনও ঝড়কে সামলে দেওয়া যায়, পাঠান-এর মধ্য দিয়ে সে কথাই যেন সকলকে বুঝিয়ে দিয়েছেন শাহরুখ খান।