বাড়িতে আসে না বিদ্যুতের বিল। বাজার থেকে কিনতে হয় না রান্নার গ্যাসও। অথচ এই গ্রামের ৫০টি পরিবার নিশ্চিন্তে দিন কাটায়। তাঁদের বাড়িতে বৈদ্যুতিন যন্ত্র-পাতিও চলে, আবার গ্যাসে রান্নার মতোই নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে রান্নাবান্নাও হয়। আর এমন অসাধ্য সাধনের দিশা দেখিয়েছেন এক প্রবীণা। কীভাবে এই প্রায় অসম্ভব কাজটি বাস্তবে সম্ভব করলেন তিনি? আসুন শুনে নিই।
বিদ্যুৎ ছাড়া আমাদের এক পা চলার উপায় নেই। প্রতিদিনের জীবনযাপনই তছনছ হয়ে যাবে, যদি বিদ্যুৎ না থাকে। যন্ত্রনির্ভর যুগে চলতে গেলে এ ছাড়া আর উপায়ই বা কী! এদিকে বিদ্যুতের বিলের কোপ পকেটে পড়ে মাসের শুরুতেই। তা নিয়েও ছাপোষা মধ্যবিত্তের সমস্যার শেষ নেই। তবে আর একটা দিকও আছে। প্রচলিত শক্তি থেকে পাওয়া বিদ্যুতের ব্যবহার ক্রমশ বিপন্ন করছে আমাদের প্রকৃতিকেই। এ যেন আত্মঘাতী সংকট। একটু ভালভাবে বাঁচার জন্য আমরা যা করছি, তাতে সংকট বাড়ছে আমাদের সামগ্রিক অস্তিত্বেরই। আর এরই একটা সমাধান বের করে ফেলেছেন জনক পালটা ম্যাকগিলিগান। তাঁর নিজের বাড়িতেও টিভি-ফ্যান চলে, তবে বিদ্যুতের জন্য খরচ নেই এক পয়সাও । এমনকী পাশাপাশি গোটা পঞ্চাশেক বাড়িকেও এই সংকট থেকে মুক্তি দিয়েছেন তিনি। কিন্তু কী এমন ম্যাজিক করেছেন তিনি? তা জানতে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে তাঁর জীবনের দিকেই।
আরও শুনুন: ছুটিতে সহকর্মীকে বিরক্ত করলেই ১ লক্ষ টাকা জরিমানা, কেন এমন নিয়ম জারি সংস্থার?
মাত্র ১৭ বছর বয়সেই তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছিল কঠিন অসুখ। ওইটুকু বয়সেই হয়েছিল ‘ওপেন হার্ট সার্জারি’। তবে ফিরে পেয়েছিলেন নতুন জীবন। আর তখনই ঠিক করেছিলেন, এই নতুন জীবনে তিনি সেই কাজই করবেন, যা কিনা মানুষের বেঁচে থাকার সহায়ক হয়। প্রকৃতিকে না বাঁচালে তা সম্ভব নয়। ছোট থেকেই তাই সমাজের জন্য কিছু করতে চাইতেন তিনি। পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই বিভিন্ন গ্রামোন্নয়ন সংস্থার হয়ে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। মহিলা ও শিশুদের সুরক্ষিত রাখাই ছিল তাঁর মূল কাজ। পাশাপাশি পরিবেশ দূষণের মতো সমস্যাও তাঁকে ভীষণভাবে নাড়া দিত। বিশেষত ব্রাজিলের আর্থ সামিট-এ যোগ দেওয়ার পর এই সমস্যার কথা আরও বিস্তারিত ভাবে জানতে পারেন তিনি। কীভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে, কিংবা পরিবেশ দূষণের ফলে সমাজের কী কী ক্ষতি হতে পারে- সেই সব কিছু সম্পর্কেই পরিষ্কার ধারণা হয় তাঁর। এরপর থেকেই পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচির কথা ভাবতে শুরু করেন তিনি।
ততদিনে বেশ কিছু মহিলা উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করার সুবাদে ‘সমাজসেবী’ হিসেবে তিনি বেশ পরিচিতিও পেয়ছেন। এরই মাঝে তাঁর স্বামী মারা যাওয়ায় তিনি সিদ্ধান্ত নেন ইন্দোরের একটি গ্রামে চলে যাবেন। সেখানে গিয়েই একটি বিশেষ ব্যবস্থার প্রচলন করেন তিনি। ইন্দোরে যে বাড়টিতে তিনি থাকতেন, সেই বাড়িকে সম্পূর্ণভাবে অপ্রচলিত শক্তিচালিত করে ফেলেন। একইসঙ্গে সেই ব্যবস্থা করেন আশেপাশের ৫০টি বাড়ির জন্যেও। প্রথমেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় বেশ কিছু উইন্ডমিল বা বায়ুকল বসিয়ে দেন তিনি। যার ফলে বিদ্যুতের ঘাটতি হচ্ছে না। রান্নার জন্যও কাজে লাগান সৌরশক্তিকে। পাশাপাশি পুরনো খবরের কাগজ ব্যবহার করে এক ধরনের বিশেষ ইট তৈরি করেন তিনি। যা সূর্যালোকের অনুপস্থিতিতে রান্নার কাজে সাহায্য করবে। এছাড়াও তাঁর বাগানে রয়েছে প্রায় ১৬০টি গাছ। একইসঙ্গে ১৩ রকমের সবজি চাষের জন্য উপযুক্ত তাঁর এই বাগান। সব মিলিয়ে তিনি এমন এক জীবন যাপন করেন, যা প্রকৃতিকে ধ্বংস করে না। বরং প্রকৃতির উপাদান নিয়েও যে তাকে বিপন্ন না করে বাঁচা যায়, তাঁরই পাঠ দিয়েছেন এই প্রবীণ পরিবেশপ্রেমী।
আরও শুনুন: ক্যারামে বাজিমাত! সেরার সেরা হয়ে সোনার পদক জিতলেন ৮৩ বছরের বৃদ্ধা
বর্তমানে স্বামীর নামে একটি ইনস্টিটিউটও খুলেছেন তিনি। যেখানে দেড় লক্ষ ছেলে মেয়েকে অপ্রচলিত শক্তির ব্যবহার নিয়ে পাঠ দেওয়া হয়। ইন্দোরের বিভিন্ন গ্রাম থেকেও এই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে আসেন অনেকে। তাঁদের সকলের কাছেই ‘জনক দিদি’ তিনি। ভারত সরকারও তাঁর এই প্রইয়াসকে সম্মান জানিয়ে তাঁকে পদ্মশ্রী পুরষ্কার প্রদান করেছে। প্রকৃতি রক্ষার স্বার্থে তাঁর এই অবদান সত্যিই অনস্বীকার্য। তবে ইন্দোরের গণ্ডি পেরিয়ে এই অপ্রচলিত শক্তির ব্যবহারের প্রবণতা যদি দেশের সর্বসাধারণকে ভাবায়, তবেই তাঁর প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ হবে।