ইহলোক ছেড়ে চলে গেলেন সুমিত্রা সেন। তবে তাঁর গায়নের সঙ্গে বাঙালির যে লগ্নতা, তা অবশ্য থেকেই যাবে। যতদিন থাকবে বাঙালি আর থাকবে তার সাধের রবীন্দ্রনাথের গান, সুমিত্রা সেনের গানের আলোয় ততদিন নতুন করে রবি ঠাকুরকে চিনে নেওয়ার পালা তার ফুরোবে না।
রবি ঠাকুরের গানে গুনগুনিয়ে ঘরেতে ভ্রমর আসার কথাটুকু কতজন না শুনিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁর মতো করে কে আর গাইতে পেরেছেন! রূপোলি পর্দায় সুপ্রিয়া দেবী যখন অভিব্যক্তিতে ফুটিয়ে তুলছেন কিশোরীর প্রথম প্রণয়-অনুভবের ঘন দিনগুলি, তখন রবিগানের সুরের খেয়া ধরে স্বতন্ত্র গায়কিতে সেই অভিব্যক্তিতেই ভাষা দান করছিলেন তিনি। তিনি সুমিত্রা সেন। বাঙালির রবীন্দ্রসঙ্গীতের আকাশ যে নক্ষত্রদের আলোয় ভরে থাকে, তাঁদের নাম যদি সুচিত্রা-কণিকা,দেবব্রত-হেমন্ত হয়, তবে সেই আকাশের অনেকখানি নিজস্ব আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন আরও এক নক্ষত্র; বাঙালির বড় প্রিয় শিল্পী- সুমিত্রা সেন। রবি ঠাকুরের গান শোনায় বাঙালির স্মৃতি-সঞ্চয়ের আখ্যান তাঁকে ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। রবীন্দ্রনাথের গানের যে হৃদয়, তা তাঁর ব্যতিক্রমী গায়নশৈলীতে এমন করে পাপড়ি মেলত যে, বাঙালি সুমিত্রাকে আর তাঁর গানকে ভারী আপন করে নিয়েছিলেন।
আরও শুনুন: ‘আপনার ফ্লোরে থাকা দরকার’ জ্বরে কাতর তরুণ মজুমদারের পাশে দাঁড়ালেন স্বয়ং সুচিত্রা
এ কথা ঠিক যে, রবীন্দ্রনাথের গান অতলস্পর্শী। এক একজন শিল্পী সেই গানকে এক একরকম চরিত্র দান করেন। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় আর সুচিত্রা মিত্র যেন তাই রবি ঠাকুরকে ছুঁয়ে দুই ঘরানা হয়ে যান। আবার দেবব্রত বিশ্বস তাঁর অনুভবঘন গায়কিতে নিজেই এক প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে রবি ঠাকুরের গানকে দূরত্বের সম্ভ্রম থেকে বের করে এনে সাধারণের অনুভবের সঙ্গে আশ্চর্য দক্ষতায় মিলিয়ে দেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। দশকের বিচারে তাঁদের কে কখন খ্যাতি, জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠেছেন সে প্রশ্ন আলাদা। উত্তরকালের বাঙালি শ্রোতা এঁদের সকলকেই পেয়েছেন আপন বৈশিষ্ট্যে। ভরে উঠেছে তাঁর নির্জন এককের গানের অযুত ভাণ্ডার। আর সেখানেই আপন স্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর সুমিত্রা সেন। ‘ঘরেতে ভ্রমর এল’, ‘সখী ভাবনা কাহারে বলে’ কিংবা ‘ছিন্ন পাতায় সাজাই তরণী’র মতো রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রসঙ্গ এলে আজও বাঙালি শ্রোতার মন পড়ে থাকে সুমিত্রার কণ্ঠেই।
আরও শুনুন: ‘নিজে ছবি ডিরেক্ট করছেন না কেন?’ সিনেমাপাড়ার তরুণকে পরিচালনায় আসার ডাক উত্তমকুমারের
সুমিত্রার শিল্পীজীবন শুরু হয়েছিল নজরুলগীতি এবং পল্লিগীতি রেকর্ডের মাধ্যমে। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথের গানই হয়ে ওঠে তাঁর আশ্রয়। বহু ছবিতে প্লে-ব্যাক করেছিলেন, যার শুরুটা হয়েছিল স্বয়ং উত্তমকুমারের অনুরোধে। রেডিওতে একদিন বাজছিল তাঁর গান, ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে’। শুনে ভাল লেগে যায় উত্তমকুমারের। পাশেই ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। তাঁর কাছেই জানতে চান শিল্পীর পরিচয়। ঠিক করেন, তাঁর পরের ছবিতে ব্যবহার করবেন সুমিত্রার কণ্ঠ। একদিন ফোন যায় শিল্পীর কাছে। সুমিত্রা পরে জানিয়েছিলেন, গলাটা খুব চেনা মনে হচ্ছিল, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছিলেন না। কেননা উলটোদিকের মানুষটি নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায় নামে। একটু পরেই অবশ্য বলে উঠলেন, ‘আমি তোমাদের উত্তমকুমার গো দিদিভাই’। ওই ‘দিদিভাই’ সম্বোধনেই সকল দূরত্ব গেল ঘুচে। পরবর্তীতে পরম সুহৃদ হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা। আর বাংলা ছায়াছবির সঙ্গীতজতকে এই সূত্রে উত্তমকুমার দিয়ে গেলেন এক আশ্চর্য কণ্ঠ। যে কণ্ঠের মায়ায় বাঙালি শ্রোতা রবীন্দ্রনাথের গানকে বড় কাছের, আপন করে চিনতে পারবে বহুকাল। মিলিয়ে নিতে পারবে জীবনের ব্যক্তিগত অনুভবের সঙ্গে। সুমিত্রার গান যেন একান্ত কোনও চিঠি হয়েই আসত বাঙালি শ্রোতার দরবারে।
‘সখী ভাবনা কাহারে বলে’ – এ গানের আবেদনও সুমিত্রার কণ্ঠে অবিস্মরণীয়। ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ ছবিতে এ গান প্রথমে গেয়েছিলেন সুমিত্রাই। পরে অবশ্য তা রেকর্ড করেন লতা মঙ্গেশকর। তরুণ মজুমদার নাকি এর জন্য যারপরনাই লজ্জিতও হয়েছিলেন। ছায়াছবিতে না থাক, বেসিক গান হিসাবে তা রেকর্ড করেন সুমিত্রা। আর বাঙালি শ্রোতার অনুরাগে তা তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ঐতিহাসিক রেডিও প্রোডাকশন ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-তে অমর হয়ে আছে তাঁর গাওয়া ‘মা গো তব সঙ্গীতে’ গানটিও।
এরকম বহু গানেরই স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে বাঙালির মনে। ৮৯ বছর বয়সে ইহলোক ছেড়ে চলে গেলেন সুমিত্রা সেন। তবে তাঁর গায়নের সঙ্গে বাঙালির যে লগ্নতা, তা অবশ্য থেকেই যাবে। যতদিন থাকবে বাঙালি আর থাকবে তার সাধের রবীন্দ্রনাথের গান, সুমিত্রা সেনের গানের আলোয় ততদিন নতুন করে রবি ঠাকুরকে চিনে নেওয়ার পালা তার ফুরোবে না।