ইংরেজি নববর্ষের দিন ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ ধরা দিয়েছিলেন ভক্তবাঞ্ছা কল্পতরু রূপে। সকল ভক্তের উদ্দেশে সেদিন তিনি বলেছিলেন ‘আশীর্বাদ করি তোমাদের চৈতন্য হউক’। পঞ্চাশের দশকে ঠাকুরের সমাধিস্থ হওয়ার দিনটিই কাশীপুর উদ্যানবাটীতে পালিত হয়ে আসছে কল্পতরু দিবস হিসেবে। তবে এই কল্পতরু শব্দটির উল্লেখ কিন্তু পুরাণেও রয়েছে। বলা হয়, এই বৃক্ষের কাছে যা চাওয়া হয় তাই নাকি পাওয়া যায়। আসুন, শুনে নিই।
যে রাম, সে-ই কৃষ্ণ, আর কলিতে তিনিই রামকৃষ্ণ! কলিযুগের এই ‘অবতার’ ১৮৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জগৎবাসীকে কৃপা করে আত্মপ্রকাশে অভয়দান করেছিলেন। বলেছিলেন, “তোমাদের কী আর বলিব, আশীর্বাদ করি তোমাদের চৈতন্য হউক।” ঠাকুরের সেই রূপ দেখে কারও মনেই সন্দেহ ছিল না তিনি আসলে কে! তবে এই দিনটিকে কল্পতরু হিসেবে আখ্যা দেওয়ার নেপথ্যে রয়েছে এক বৃক্ষ।
আরও শুনুন: পৌষ মাসে মুলো দিয়ে মা কালীর পুজো দেওয়া হয়, নেপথ্যে কোন কারণ?
পুরাণে অমৃত উত্থানের ঘটনায় উল্লেখ মেলে এক দৈব বৃক্ষর। সমুদ্র মন্থনকালে অমৃত, দেবী লক্ষ্মী, ঐরাবত হাতি, কৌস্তুভ মনি ইত্যাদির সঙ্গেই নাকি উঠে এসেছিল পারিজাত নামে এক গাছ। প্রথমে যার স্থান হয়েছিল দেবরাজ ইন্দ্রের নন্দনকাননে। কিন্তু দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণ, স্ত্রী সত্যভামার আবদারে সেই স্বর্গীয় গাছ নিয়ে আসেন মর্তে। পুরাণমতে এই পারিজাত বৃক্ষই আসলে ‘কল্পতরু বৃক্ষ’। দৈব বৃক্ষের গুণ হল, এর কাছে ভালো-খারাপ, যা-ই চাওয়া হয়, তা-ই মেলে। এ প্রসঙ্গেই উঠে আসে ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণের কল্পতরু রূপে প্রকাশিত হওয়ার ঘটনাটি। এই ঘটনার আগে ঠাকুরের পরম ভক্ত গিরিশ ঘোষ প্রবল ভাবে বিশ্বাস করতেন ঠাকুর নিশ্চয়ই একজন দৈব অবতার। কিন্তু এইদিনের পর সেই বিশ্বাসে ভাগ হয়ে গিয়েছিল বাকি ভক্তদের মধ্যেও। বিশেষত একজন গৃহী ভক্ত, যিনি বিশ্বাস করতেন এ যুগে বোধহয় আর অবতার নেই, তাঁর মনের সকল দ্বিধাও দূর হয়েছিল কাশীপুর উদ্যানবাটীর এই ঘটনায়।
ঠিক কী ঘটেছিল কাশীপুরে?
আরও শুনুন: ‘আমাকে কি ত্যাগ করবেন?’ প্রশ্ন ধর্মত্যাগী মাইকেল মধুসূদনের, ঠাকুর বললেন…
অসুস্থ হয়ে কাশীপুরের উদ্যানবাটীতে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছিলেন শ্রী রামকৃষ্ণ। সেখানে তাঁকে দেখতে প্রায়শই ভক্তরা হাজির হতেন। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলিতে এই ভিড় চোখে পড়ার মতো হতো। ১৮৮৬ সালে নববর্ষের দিনটিতেও বিভিন্ন জায়গা থেকে ঠাকুরকে দেখতে এসেছিলেন ভক্তরা। শোনা যায়, সেদিন নাকি খানিক সুস্থও বোধ করেছিলেন ঠাকুর। গৃহী ভক্তদের অনেকেই সেদিন এসেছেন কাশীপুর উদ্যানবাটীতে। বেলা একটু পড়তে, বিকেল তিনটে নাগাদ ঠাকুর এসে দাঁড়ান বাগানে। গিরিশচন্দ্র ও অন্যান্য ভক্তরা ছিলেন একটু দূরে, ঠাকুরকে দেখে তাঁরা কাছে ছুটে এলেন। কেউ কিছু কথা বলবার আগেই ঠাকুর গিরিশচন্দ্রকে সম্বোধন করে বললেন,”গিরিশ, তুমি যে সকলকে এত কথা বলিয়া বেড়াও, তুমি কী দেখিয়াছ ও বুঝিয়াছ?” গিরিশ বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে ঠাকুরের পদপ্রান্তে ভূমিতে বসে ঊর্ধ্বমুখে করজোড়ে গদগদ স্বরে বলে উঠলেন, “ব্যাস-বাল্মীকি যাহার ইয়ত্তা করিতে পারেন নাই, আমি তাহার সম্বন্ধে অধিক কী আর বলিতে পারি!” গিরিশের সরল বিশ্বাসে ঠাকুর মুগ্ধ হলেন। তারপর সমবেত ভক্তদের উদ্দেশে বললেন, “তোমাদের কী আর বলিব, আশীর্বাদ করি তোমাদের চৈতন্য হউক।” তারপর থেকে এই দিনটিই কাশীপুর উদ্যানবাটীতে পালিত হয়ে আসছে কল্পতরু দিবস হিসেবে। বলা হয়, কল্পতরু বৃক্ষের মতো ঠাকুরের এই রূপটিকে স্মরণ করে ভক্তরা মনে মনে যা আশা করেন তার সবই পূরণ হয়।