বিশ্বকাপের ইতিহাসে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য মণিমুক্তো। কিছু তার মনে আছে, কিছু বা ঢাকা পড়ে গিয়েছে বিস্মৃতির কুয়াশায়। মাঠ আর মাঠের বাইরের নানা রঙের চরিত্রদের ফিরে দেখা চলতি বিশ্বকাপের মরশুমে। শুনে নিই বিশ্বকাপে ট্রফি চুরির গল্প, শোনাচ্ছন সৌরাংশু।
শুধু যে আমাদের দেশে রবি ঠাকুরের নোবেল চুরি হয়ে যায়, তাই নয়; এই যে ফুটবল বিশ্বকাপের ট্রফি, তাও হাতিয়েছিল চোরেরা। একবার নয়, ট্রফি চুরির ঘটনা ঘটেছে দু’বার। প্রথমবার বিশ্বকাপের ট্রফি চুরি হয়েছিল ১৯৬৬-তে, ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের আগে। ওয়েস্ট মিনিস্টারের কেন্দ্রীয় হলে, ছেষট্টির মার্চ মাসে, সুদৃশ্য় জুলে রিমে কাপটি প্রদর্শনীতে রাখা ছিল ১৯ মার্চ থেকে। কিন্তু পরের দিন দুপুরে যখন সুরক্ষাকর্মীরা প্রদর্শনীর হলঘরের দরজা খোলেন, তখন দেখেন যে, কেউ ভিতর থেকে ট্রফিটি চুরি করে নিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছে।
আরও শুনুন: ছিল না নাগরিকত্ব, মার্কিন দলের হয়ে গোল করে জাতীয় বীরের তকমা এই তারকার
ট্রফিটি উদ্ধারের জন্য সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব দেওয়া হয় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে। তারা বিভিন্ন অধিকারী এবং সুরক্ষাকর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। এঁদের মধ্যেই একজন জানান যে, রহস্যজনক অচেনা এক ব্যক্তিকে আগের দিন বিকেলে কাছের টেলিফোন বুথে দেখা গিয়েছে। চলল আরও জিজ্ঞসাবাদ। তবে তেমন সূত্র মিলছিল না। রহস্যে আলো পড়ল অন্য দিক থেকে। ২১ মার্চ ইংল্যান্ডের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বা এফএ-র সভাপতি জো মেয়ার্স এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির ফোনকল পেলেন। তাঁকে ফোন করে জানানো হল যে, ২২ তারিখ চেলসি ফুটবল ক্লাবে একটা পার্সেল পাওয়া যাবে। কথামতো, পরের দিন সেটি পাওয়াও যায় এবং সেই পার্সেলের সঙ্গে দেখা মেলে একটি চিঠির। চিঠিতে যা লেখা তার অর্থ হল এই যে, ফেলো কড়ি মাখো তেল। অর্থাৎ মুক্তিপণ দিয়ে তবে ফেরত নিয়ে যাও বিশ্বকাপের ট্রফি। তা মুক্তিপণের অঙ্কটা নেহাত কম ছিল না, দাবি করা হয়েছিল ১৫০০০ পাউন্ড। এই মর্মে একটা ফোনকলও পান মেয়ার্স, জ্যাকসন নামক জনৈক ব্যক্তির থেকে।
আরও শুনুন: একই ম্যাচে একজন খেলোয়াড়কে তিন বার হলুদ কার্ড, নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী ছিল বিশ্বকাপ
ফোনে যেমনটা বলা হয়েছিল, সেই অনুযায়ী কাজ করতে শুরু করলেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা চার্লস ব্যাগি। ছদ্মবেশ ধারণ করলেন তিনি, তারপর ব্যাঙ্ক থেকে সাদা কাগজের উপর কিছু আসল নোটের তাড়া একটা ব্যাগে নিয়ে, নির্দিষ্ট স্থান অর্থাৎ ব্যাটারসি পার্কে হাজির হলেন। সেখানেই এসে দাঁড়াল সেই জ্যাকসন। ব্যাগ খুলে তাকে দেখানো হয় যে টাকা আনা হয়েছে। জ্যাকসন অবশ্য গোয়েন্দার চালাকি ধরতে পারেনি। ব্যাগিকে বলে যে, ট্রফিটা তার কাছে নেই, কিন্তু কোথায় আছে সে জানে। তাই ব্যাগির গাড়িতে উঠে ট্রফি আনতে সম্মত হয়। কিন্তু গাড়ি করে যেতে যেতে জ্যাকসন খেয়াল করে যে পিছনে ছুটে আসছে স্কটল্যান্ড উয়ার্ডের ফ্লাইং স্কোয়াডের গাড়ি। গোলমাল অনুমান করেই সে একটা ফন্দি আঁটে। ব্যাগিকে কেনিংটন পার্ক রোডের একটা লালবাতিতে গাড়ি দাঁড় করাতে বলে, জানায় যে, ট্রফিটা নিয়েই সে ফিরে আসছে। এই না বলে পাশের গলিতে উধাও হয়। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই ব্যাগি এবং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বাকি গোয়েন্দারা তার পিছু ধাওয়া করেন, ধরেও ফেলেন। কেনিংটন পুলিস স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হলে জ্যাকসন জানায়, তার আসল নাম এডওয়ার্ড বেচলি। সে আরও জানায় যে, ট্রফি তার কাছে নেই, কিন্তু ‘দ্য পোল’ বলে কেউ একজন তাকে ৫০০ পাউন্ডের সওদায় এই দালালি করতে বলেছে। তার প্রতিশ্রুতি যে, ছাড়া পেলে সে নাকি ট্রফিটা জোগাড় করে আনতে পারবে। পুলিস অবশ্য সেসব কথায় আর বিশ্বাস করেনি। বিশ্বকাপ চুরির অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করে।
আরও শুনুন: তরুণী সাংবাদিককে দেখে হারিয়েছিলেন মনোসংযোগ, তাঁকেই মন দিয়েছিলেন তারকা
এত কাণ্ড ঘটল বটে, তবে ট্রফি কিন্তু তখনও উদ্ধার হয়নি। শেষে ২৭ মার্চ, ১৯৬৬ দক্ষিণ পূর্ব লন্ডনের বেউলা হিল অঞ্চলে ডেভিড করবেট নামে জনৈক ভদ্রলোকের কুকুর ‘পিকলস’, করেবেটের বাড়ির পিছনের ঝোপঝাড় থেকে উদ্ধার করে একটি বস্তুকে। ভালো করে কাগজে মোড়া ছিল জিনিসটা। করবেট সেটা থানায় নিয়ে এলে বোঝা যায় যে সেটি আর কিছুই নয়, সেই কাঙ্ক্ষিত জুলে রিমে ট্রফি। ‘পিকলস’ তো এরপর সুপারস্টারের মর্যাদা পায়, এবং করবেটকে বিশ্বকাপ ফাইনালের পরে জয়ীদের নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আর তার পরের বিশ্বকাপেই তিনবারের বার বিশ্বকাপ জিতে ট্রফিটি সম্পূর্ণভাবে নিজেদের করে নেয় ব্রাজিল। তাতেই গল্প শেষ নয়। ১৯৮৩-তে ব্রাজিলের ফুটবল ফেডারেশন সিবিএফের অফিস থেকে আবার চুরি হয় জুলে রিমে ট্রফি। সে ট্রফি আর ফেরত পাওয়া যায়নি। ১৯৮৪-তে ফিফা সিবিএফকে সেই আসল জুলে রিমে ট্রফির-ই একটা প্রতিরূপ দেয়, যা এখনও রাখা আছে সিবিএফের কার্যালয়ে।