শুভ শক্তির হাতে অশুভ শক্তির বিনাশ। পুরাণের গল্পগুলিতে মূলত এমনই দৃশ্য দেখা যায়। আর উল্লেখ পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের। দেবতাদের কাছে স্বাভাবিক ভাবে সেইসব অস্ত্র থাকলেও। অসুররা দীর্ঘ তপস্যা করে সেইসব অস্ত্র বর হিসেবে পেতেন। তবে দেবলোকে এমন কিছু অস্ত্র ছিল যার অধিকারী কেবলমাত্র ত্রিদেব। সৃষ্টির যেকোনো কিছুই যা ধংস করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কোন কোন অস্ত্র রয়েছে সেই তালিকায়? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
রামায়ণ হোক বা মহাভারত যেকোনও পৌরাণিক গল্পেই যুদ্ধের উল্লেখ মেলে। এছাড়াও অসুরদের স্বর্গরাজ্য দখলের কাহিনীতেও আমরা ভয়ঙ্কর সব যুদ্ধের কথা জানতে পারি। স্বাভাবিক ভাবেই যুদ্ধের সঙ্গেই উঠে আসে অস্ত্রের প্রসঙ্গ। পুরাণ মতে, দেবতাদের কাছে নাকি তিন হাজার রকমের অস্ত্র রয়েছে। যা ঘটনা ক্রমে অসুরদের হাতেও উঠেছে। কঠোর তপস্যার মাধ্যমে দেবতাদের থেকেই সেইসব অস্ত্র লাভ করতেন অসুররা। তবে পুরাণে এমন কিছু বিশেষ অস্ত্র রয়েছে যা ধারণ করার ক্ষমতা কেবল ত্রিদেবের। ভক্তের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে বিশেষ শর্তে প্রদান করলেও এইসব অস্ত্রের আসল ধারক তাঁরাই।
আরও শুনুন: দেবতাদের সেনাপতি নয়, বাংলার ঘরে কার্তিকের আদর সন্তানের মতোই
ত্রিদেবের নাম করতে গেলে প্রথমেই আসে ব্রহ্মদেবের কথা। তিনিই নাকি জগত সংসার সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর প্রচলিত মূর্তির রূপও সংহারক নয়। তবু তাঁর কাছেই রয়েছে অন্যতম শক্তিশালী কিছু অস্ত্র। বলা হয় ব্রহ্মদেব মূলত তিনটি অস্ত্রের প্রধান অধিকারী। যার মধ্যে রয়েছে ব্রহ্মাস্ত্র, ব্রহ্মশিরাস্ত্র ও ব্রহ্মদণ্ডাস্ত্র।প্রতিটি অস্ত্রেরই রয়েছে ভয়ঙ্কর বিধ্বংসী ক্ষমতা। একবার চালনা করলে সেগুলি থামানোর ক্ষমতা কারও নেই। সৃষ্টিকর্তা হিসেবে স্বয়ং ব্রহ্মদেব সেইসব অস্ত্র সচরাচর প্রয়োগ না করলেও, তাঁর তপস্যা করে অনেকেই এইসব দীব্যাস্ত্র লাভ করেছেন। এমনকি মহাভারতের যুদ্ধেও আমরা এই ভয়ঙ্কর ব্রহ্মাস্ত্রের উল্লেখ পাই। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যে অস্ত্র প্রয়োগ করে অভিমন্যুর সন্তান তথা পাণ্ডবদের শেষ বংশধরের হত্যা করেছিল অশ্বত্থামা। যুদ্ধ ক্ষেত্রে উপস্থিত থাকা কোনও মহারথী সেই অস্ত্র থামাতে পারেননি। এরপর বলতে হয় দেবাদিদেব মহেশ্বরের অস্ত্রটির কথা। সাধারণত মহাদেবের মূর্তিতে অস্ত্র হিসেবে ত্রিশূলকেই দেখতে পাই আমরা। কিন্তু মহাদেবের কাছে থাকা সব থেকে ভয়ঙ্কর অস্ত্রটি হল পশুপাত অস্ত্র। অতীব ভয়ঙ্কর এই অস্ত্রটি মনে মনে কল্পনা করেও নিক্ষেপ করা যায়। সাধারণ তৃণখণ্ড থেকে আরম্ভ করে যেকোনও বস্তকেই মন্ত্রের দ্বারা পশুপাত অস্ত্রে পরিণত করা সম্ভব। শোনা যায় মহা ভারতের যুদ্ধের আগে অর্জুন স্বয়ং মহাদেবের কাছ থেকে এই অস্ত্রের জ্ঞান লাভ করেন। যা প্রয়োগ করে তিনি সিন্ধুরাজ জয়দ্রথের হত্যা করেছিলেন। এছাড়াও মহেশ্বরের কাছে রুদ্রাস্ত্র নামেও এক অতি ভয়ঙ্কর অস্ত্র রয়েছে। ত্রিদেবের মধ্যে এরপরেই স্বয়ং বিষ্ণুর নাম উঠে আসে। তাঁর ব্যবহৃত প্রধাণ অস্ত্রটি হল সুদর্শন চক্র। শ্রীবিষ্ণু মূলত এই অস্ত্রের ব্যবহার করেই দুষ্টের দমন করেন। মহাভারতেও একাধিকবার এই চক্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। দেবী মহামায়া ব্যতীত অন্য কাউকে এই অস্ত্র প্রদান করেননি নারায়ন। অনেকেই তাই সুদর্শণ চক্রকেও নারায়নের সঙ্গেই পুজো করে থাকেন। তবে সুদর্শন ছাড়াও বিষ্ণুর কাছে রয়েছে বৈষ্ণবাস্ত্র। পৌরাণিক গল্পগুলিতে এই বিশেষ অস্ত্রের উল্লেখ বিশেষ ভাবে না পাওয়া গেলেও এই অস্ত্র অতীব ভয়ঙ্কর। বলা হয় এই অস্ত্র একবার নিক্ষেপ করলেই আকাশে এক বিশাল গহ্বরের সৃষ্টি হয়। এবং সেখান থেকে ক্রমাগত বিভিন্ন অস্ত্রের বর্ষণ হতে থাকে। সামনে থাকা কাউকেই রেহাই দেয় না এই অস্ত্র। তবে এর থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় নিজেকে সমর্পণ করা। তাহলেই প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা সম্ভবপর হয়।
আরও শুনুন: দ্বন্দ্ব সৃষ্টিতে নাকি অগ্রণী তিনি, কীভাবে জন্ম হয়েছিল দেবর্ষি নারদের?
ত্রিদেবের কাছে গচ্ছিত এই তিন দিব্যাস্ত্র ছাড়াও পুরাণে আরও কিছু ভয়ংকর অস্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। একটি অস্ত্রকে থামানোর উদ্দেশ্য নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে আরও একটি অস্ত্র। যেমন নাগাস্ত্রের বিপরীতে তৈরি হয়েছে গড়ুরাস্ত্র তেমনি আগ্নেয়াস্ত্রের বিপরীতে রয়েছে বরুনাস্ত্র। সবকটি অস্ত্রেরই রয়েছে ভয়ঙ্কর বিধ্বংসী ক্ষমতা। স্বয়ং রামচন্দ্র সহ অধিকাংশ পৌরাণিক চরিত্ররাই এইসব অস্ত্র তপস্যা করে লাভ করেছিলেন। এবং এইসব অস্ত্র ব্যবহার করেই অশুভ শক্তির হাত থেকে সৃষ্টিকে রক্ষা করছেন দেবতারা।