হর-পার্বতীর যোগ মিলনের মাধ্যমে তাঁর সৃষ্টি। জন্মের পর তাঁকে পালন করার দায়িত্ব পান কৃত্তিকাগণ। সেই সূত্রেই তাঁর নাম হয় কার্তিক। যার জন্মের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভয়ানক তারকাসুরের বিনাশ। দেবসেনাপতি হিসেবে ত্রিভুবনে পুজো পেলেও বাংলায় তাঁকে পুজো করার বিশেষ কিছু কারণ রয়েছে। আসুন শুনে নিই।
‘কার্তিক ঠাকুর হ্যাংলা, একবার আসে মায়ের সঙ্গে একবার আসেন একলা’- বাংলায় অতি প্রচলিত এই প্রবাদ বাক্যটির উৎপত্তি ঠিক কবে হয়েছিল সেকথা সঠিকভাবে জানা না গেলেও, বাংলার ঘরে ঘরে তিনি পূজিত হন সন্তান রূপেই। তাঁর মতো বলিষ্ঠ সুঠাম চেহারার সন্তান যে কোনও সদ্য বিবাহিত দম্পতির একান্ত কাম্য। তাই তাঁর পুজোকে কেন্দ্র করে একাধিক জনশ্রুতির প্রচলন রয়েছে। যদিও বাংলার বাইরে কার্তিকের রূপ খানিকটা আলাদা। এমনকি পুরাণমতেও তাঁর সঙ্গে সন্তান জন্মের কোনও যোগ নেই বললেই চলে। তবে একথা সত্য স্বয়ং কার্তিকের জন্ম হয়েছিল এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই।
আরও শুনুন: পক্ষীকুলে শ্রেষ্ঠ বলেই কি দেবসেনাপতির বাহন হল ময়ূর?
পুরাকালে বজ্রাঙ্গ নামে এক ভীষণ দানব ছিলেন। ত্রিভুবন জয় করেও তিনি ব্রহ্মদেবের বরে পরম ধার্মিক হিসেবে জীবন কাটাতেন। এমনকি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে অসুররাজ্যের প্রাচুর্য ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যেই বাস করতেন তিনি। কোনও একদিন দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে এই দানব ও তাঁর পত্নীকে চরম উত্যক্ত করেন। যার ফলে ভয়ানক রেগে গিয়ে বজ্রাঙ্গ সিদ্ধান্ত নেন দেবরাজ ইন্দ্রের চরম শাস্তির ব্যবস্থা করবেন তিনি। তখনই ব্রহ্মার তপস্যায় বসেন তিনি। দীর্ঘ তপস্যার পর স্বয়ং প্রজাপতির কাছে এক ত্রিভুবন জয়ী পুত্রের বরলাভ করেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই জন্ম হয় তারকাসুরের। প্রবল পরাক্রমী সেই অসুর বল-বুদ্ধি সবেতেই ছিলেন দেবতার থেকে এগিয়ে। পিতার আদেশে তিনিও ব্রহ্মদেবের তপস্যায় বসেন। প্রায় ১০০০ বছর ধরে তপস্যার পর ব্রহ্মদেব তাঁকে দেখা দেন। উত্তেজিত হয়ে প্রথমেই তিনি অমরত্বের বর চেয়ে ফেলেন। কিন্তু তেমন বর দিতে ব্রহ্মদেব অপারগ হওয়ায় এক বিশেষ শর্তে অমর হওয়ার বর পান তারকাসুর। ব্রহ্মার বর অনুসারে ত্রিভুবনে কেউই তাঁকে পরাস্ত করতে পারবে না। কেবলমাত্র দেবাদিদেব মহাদেবের বালক পুত্র যদি তাঁর দিকে বাণ নিক্ষেপ করেন তাহলেই তাঁর মৃত্যু হবে। এমন বর পেয়ে মহা উল্লাসে স্বর্গের উদ্দেশে যাত্রা করেন তারকাসুর। দেবতাদের বন্দি করে অমরাবতীর রাজ সিংহাসন দখল করেন তিনি। এদিকে দেবতারা জানতেন মহাদেবের পুত্র ব্যতীত তারকাসুরের বধ অসম্ভব। তাই সকলে মিলে দেবাদিদেবের শরণাপন্ন হন। সেখানেও কোনও আশার আলো ছিল না। কারণ মহেশ্বর প্রায় সবসময়ই ধ্যানে মগ্ন হয়ে থাকতেন। অগত্যা দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে থাকেন দেবতারা।
এরপর একদিন মহাদেবের শরীরে কামাগ্নি জ্বালানোর জন্য কামদেব মদনকে মহেশ্বরের কাছে পাঠান ইন্দ্র। কিন্তু মদন তাঁর দিকে বাণ নিক্ষেপ করা মাত্রই খুলে যায় মহাদেবের তৃতীয় নয়ন। ভয়ঙ্কর ভাবে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে আগুন। ভুল বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে মহাদেবের কাছে ক্ষমা চান দেবতারা। পরে শান্ত হয়ে মহেশ্বর দেবতাদের সমস্যার কথা জানেন। এবং বলেন সেই মুহূর্তে দেবী পার্বতীর সঙ্গে রতিক্রিয়ায় লিপ্ত না হলেও যোগবলে পুত্রের জন্ম দেওয়া সম্ভব। সেই মতো মহাদেব ও পার্বতীর যোগ মিলনে তৈরি হয় এক জ্যোতির্বলয়। যা থেকে বেরিয়ে আসেন এক দেবশিশু। প্রথমে তাঁর লালন-পালনের দায়ভার পান কৃত্তিকাগণ। তাঁরাই এই দেবশিশুর নাম রাখেন কার্তিক। আবার সেই শিশুর ছয়টি মাথা থাকার জন্য তাঁকে ষড়ানন নামেও ডেকে থাকেন অনেকেই। কার্তিকের জন্মানোর খবর পেয়েই দেবতারা তাঁকে শিবলোকে নিয়ে আসেন। কার্তিককে তাঁর জন্মানোর আসল উদ্দেশ্যও জানান হয়। সব কিছু শুনেই কার্তিক যুদ্ধের ঘোষনা করেন। বয়সে অভীজ্ঞতা দেবতাদের থেকে কয়েকগুণ কম হলেও কার্তিকের তেজের সামনে দাঁড়াতে সাহস হয়নি কোনও অসুরের। তাঁর ছোড়া বাণেই মৃত্যু হয় তারকাসুরের। এবং দেবতারাও স্বস্তি পান।
আরও শুনুন: লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ কি দেবী দুর্গার সন্তান?
তবে পুরাণ কার্তিক সম্পর্কে এত কিছু বললেও বাংলার ঘরে ঘরে তাঁর সন্তান রূপটিই বেশি প্রচলিত। এমনকি দেবী দুর্গার মূর্তিতেও কার্তিককে দেখা যায় মহামায়ার সন্তান হিসেবে। যদিও ভারতের অন্যান্য প্রদেশে কার্তিকের প্রচলিত মূর্তিটি কিছুটা আলাদা। দক্ষিণ ভারতে তাঁকে ডাকাও হয় মুরাগন নামে। পুরাণের বর্নণার পাশাপাশি সেখানেও প্রচলিত রয়েছে বেশ কিছু লোককথা। তবে বাংলার ঘরে কার্তিক চিরকালের আদরের সন্তানই।