এই রোগে আক্রান্ত হলে সারাদিনে ২০ ঘণ্টা কিংবা তারও বেশি সময় ঘুমিয়ে কেটে যায় রোগীর। আর ঘুম ভাঙলেই দেখা দেয় রাক্ষুসে খিদে। টানা তিন-চার দিন ধরে চলে এই অবস্থা। কিন্তু কেন হয় এমন অদ্ভুত রোগ? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
রামায়ণের কুম্ভকর্ণের কথা কে না জানে! তাঁর বীরত্ব নিয়ে যত কথা হয়, তার চেয়েও বেশি কথা হয় তাঁর বিখ্যাত ঘুম নিয়ে। বলা হয়, বছরের ৬ মাস তিনি ঘুমিয়েই কাটাতেন। আর জেগে উঠলেই সামনে যা থাকত সবকিছু খেয়ে ফেলতেন। কিন্তু মহাকাব্যের এমন ঘটনা কি বাস্তবে ঘটতে পারে? বিজ্ঞান বলছে, হ্যাঁ, তেমনটা সত্যিই সম্ভব। এর জন্য দায়ী একটি বিরল রোগ। যার নাম ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোম।
আরও শুনুন: ভক্তদের প্রণামী থেকে মাথার চুল বিক্রি… বিভিন্ন পথে তিরুপতির তহবিলে কোটি কোটি টাকা
এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের কুম্ভকর্ণের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। দিনে প্রায় ২০ ঘন্টাই বিছানায় কাটতে পারে তাঁদের। পাশাপাশি হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া খিদে, স্বাভাবিক ব্যবহারে পরিবর্তন ইত্যাদি উপসর্গও দেখা যায় এই রোগের কারণে। একবার এই রোগে আক্রান্ত হলে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে রোগীর। সবথেকে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল, প্রাথমিক ভাবে এই রোগ শনাক্ত করার কোনও উপায় এখনও আবিষ্কার হয়নি। ফলে অনেকেই প্রথমদিকে বুঝতে পারেন না তাঁদের শরীরে এই রোগ বাসা বেঁধেছে।
আরও শুনুন: গর্ভনিরোধক বড়ি খেলে মহিলাদের সম্পর্কে কী ভাবে পুরুষরা? জানাল সমীক্ষা
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসের ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোমের হাতেগোনা কিছু রোগী পাওয়া যায়। এই রোগের সর্বপ্রথম যে রেকর্ড পাওয়া যায়, তাতে অষ্টাদশ শতকের ফরাসি চিকিৎসক ডি বুশ্যানে ২৪ বছরের এক তরুণীর শরীরে এই অদ্ভুত রোগ আবিষ্কার করেন। ওই তরুণী মাঝে মাঝে প্রায় ২০-২২ ঘণ্টাই ঘুমিয়ে কাটাতেন। ডি বুশ্যানে উল্লেখ করেন- এই দীর্ঘ ঘুমের বিপত্তি একদিন থেকে শুরু করে আট দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল, এবং এরকম অন্তত চারবার ঘটে। কিন্তু যেহেতু এই রোগটি রীতিমতো বিরল, তাই এটি বাকি চিকিৎসকদের মধ্যে তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। কিন্তু ১৯২৫ সালে উইল ক্লেইন নামে এক স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ এরকম আরও পাঁচজন রোগী খুঁজে পান। ক্লেইনের চার বছর পর নিউ ইয়র্কের সাইকিয়াট্রিস্ট ম্যাক্স লেভিনও ঘুমের সমস্যার রোগী নিয়ে কাজ শুরু করেন। এরকম কিছু রোগীর কথা প্রকাশ করেন তিনিও। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪২ সালে এক স্নায়ুরোগ বিশারদ ক্লেইন এবং লেভিনের গবেষণাকে আরও বিশদ আকারে করার প্রয়াস নেন। তাঁদের নামানুসারেই এই রোগের নাম হয় ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোম।
কিন্তু এইভাবে ঘুমিয়ে পড়াকে এত ভয়ঙ্কর বলে কেন মনে করছেন চিকিৎসকেরা? একে একরকম স্লিপ ডিসঅর্ডার বলেই চিহ্নিত করছেন তাঁরা। সাধারণত ঘুমের ফলে মানুষের শরীর বিশ্রাম পায়, ঘুম থেকে উঠে ফের নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে। কিন্তু এই ঘুম যেহেতু স্বাভাবিক নয়, ফলে এখানে ক্লান্তি কেটে যায় না কিছুতেই। ঘুম, খিদে, যৌন চাহিদার মতো স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াগুলি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। কথাবার্তা আর আচার-আচরণেও স্বাভাবিক সংযম আর থাকে না। আবার এই রোগে আক্রান্ত কেউ ঘুমিয়ে পড়লে তাঁকে ডেকে তোলাও বড় রকমের ক্ষতি করতে পারে। জোর করে তোলা হলে তাদের মধ্যে অস্থিরতা, আক্রমণাত্মক মনোভাব, অবসাদ, এমন বিভিন্ন মনোবিকার দেখা দিতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে কথা জড়িয়ে যেতে পারে। প্রভাব পড়তে পারে দেহের আভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলিতেও। কেউ কেউ এই রোগকে অটোইমিউন ডিজিজ বলেও মনে করেছেন, যেখানে শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা আমাদের সুস্থ কোশগুলোর বিরুদ্ধেই কাজ করতে থাকে। এই রোগের লক্ষণ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে জানতে এখনও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা।