মহিষাসুরবধের পর এক সিংহবাহনা দেবী প্রকট হয়েছিলেন দেবতাদের অহং নাশ করতে। গোটা জগতটাকে তিনিই ধারণ করে আছেন। ধ্যানমন্ত্র অনুসারে তাঁর প্রকাশ হয় সত্ত্বগুণে। সৃষ্টি আদিলগ্নের নির্মাতা মহামায়ার এই রূপের নাম জগদ্ধাত্রী। আসুন শুনে নিই দেবী জগদ্ধাত্রীর কাহিনি।
শরতে শারদা বিদায়ের মনখারাপ ভুলিয়ে দিতেই মর্ত্যে আগমন হয় হৈমন্তিকার। দুর্গানবমীর ঠিক একমাস পরে কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিই তাঁর পূজার দিন। তবে দেবী দুর্গা মতো চারদিন নয়। শাস্ত্রমতে জগদ্ধাত্রী পুজোয় একই দিনের বিভিন্ন প্রহরে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথির পুজো করতে হয়। এছাড়াও দেবীর পুজোর জন্য দরকার হয় একনিষ্ঠ ভক্তি আর অহংশূন্য মন।
আরও শুনুন: মা কালীর বিশেষ কয়েকটি রূপের পুজো করেন না গৃহস্থরা, নেপথ্যে শাস্ত্রের কোন কারণ?
পুরাণ বলে, যুগে যুগে যতবার দেবতারা অহংকারের জালে জর্জরিত হয়ে অরাজকতার চরমে পৌঁছেছেন ততবার দেবী মহামায়া বিভিন্ন রূপে আবির্ভূতা হয়ে তাঁদের সেই ভ্রম ধ্বংস করেছেন। দেবী জগদ্ধাত্রীর জন্মও সেই কল্পেই। দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধের পর পুনরায় স্বর্গরাজ্য ফিরে পান দেবতারা। কিছুকাল নির্বিঘ্নে কাটানোর পরই অদ্ভুত এক ভ্রম জন্ম নেয় তাঁদের মনে। যেহেতু দেবী দুর্গাকে দেবতারা সম্মিলিত ভাবে তাঁদের শক্তি প্রদান করেছিলেন, তাই তাঁদের মনে হতে থাকে মহিষাসুর বধের সমস্ত কৃতিত্ব তাঁদেরই। অহংকারের চরমে পৌঁছে তাঁরা দেবীর ক্ষমতা নিয়ে রীতিমতো পরিহাস আরম্ভ করেন অমরাবতীতে বসে। সেই পরিহাসের তীব্রতা দেবী মহামায়ার কাছেও পৌঁছায়। তারপরেই স্বর্গের আকাশে এক আশ্চর্য জ্যোতির দেখা মেলে। দেবতারাও সেই আলোর সামনে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে সেই আলোর তীব্রতা কমে এলে দেবতারা দেখেন ইন্দ্রসভায় পড়ে আছে এক তৃণখণ্ড। এবং সেই তৃণখণ্ডকে নির্দেশ করে আড়াল থেকে এক নারী কণ্ঠ তাঁদের বলছেন, ক্ষমতা থাকলে এই তৃণখণ্ডটি ধ্বংস করে দেখান! প্রথমে এই ব্যাপারটিকে খুবই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দেখেন দেবতারা। কিন্তু অদ্ভুতভাবে সেই তৃণখণ্ডের ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেন না তাঁরা কেউই। নিজেদের যাবতীয় শক্তির চরম প্রয়োগ করেও সেই তৃণখণ্ড একটুও সরাতে পারেননি দেবতারা। তখনই তাঁরা বুঝতে পারেন এ কোন সাধারণ ঘটনা নয়।
আরও শুনুন: সোমবার শিবের উপাসনা করলে পূর্ণ হয় মনস্কামনা, জানায় দৈবী কাহিনি
নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে তাঁরা সমস্বরে দেবী মহামায়ার স্তব করতে আরম্ভ করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রকট হন চতুর্ভূজা দেবী। সেই দেবী সিংহের পিঠে আসীন, নানা অলঙ্কারে ভূষিতা এবং নাগরূপ যজ্ঞোপবীতধারিণী। দেবীর দুই বাম হাতে শঙ্খ ও শার্ঙ্গধনু এবং দুই ডান হাতে চক্র ও পঞ্চবাণ। দেবীর দেহ থেকে বিচ্ছুরিত আলোয় দেবতাদেরও চোখ ধাঁধিয়ে গেল। তাঁর সামনে কড়জোরে নিজেদের সমর্পণ করলেন দেবতারা। তখন দেবী স্বয়ং নিজের পরিচয় দিয়ে জানালেন, জগতের সব কিছুই তাঁর নির্দেশে হচ্ছে। তিনিই আদি অনন্ত মহামায়া চণ্ডিকার অন্যতমা, দেবী জগদ্ধাত্রী।
আরও শুনুন: দ্বন্দ্ব সৃষ্টিতে নাকি অগ্রণী তিনি, কীভাবে জন্ম হয়েছিল দেবর্ষি নারদের?
দেবী জগদ্ধাত্রীর আবির্ভাবের এই কাহিনী অধিক প্রচলিত হলেও, বিভিন্ন পুরানে দেবীকে ঘিরে আরও অনেক কথা লেখা রয়েছে। উপনিষদ অনুসারে এই দেবী প্রথমে দেখা দিয়েছিলেন এক যক্ষীর বেশে। আর স্বরূপে আবির্ভূতা হওয়ার পর তাঁর নাম জানা গিয়েছিল উমা হৈমবতী। তবে শ্রী শ্রী চণ্ডি অনুসারে তিনি দেবী দুর্গারই অন্যতম রূপ। যুদ্ধের সময় মত্ত মহিষাসুর নানা মায়ারূপ ধরে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন দেবী দুর্গাকে। একবার সেই প্রচেষ্টায় মহিষাসুর ধারণ করেন হস্তীরূপ। সেই হস্তী দেবীকে বধের চেষ্টা করলে দুর্গা ধারণ করেন এক চতুর্ভুজা মূর্তি। চক্রদ্বারা তিনি ছেদন করেন হাতির মাথা। চন্ডি অনুসারে সেই রূপটিই দেবী জগদ্ধাত্রীর। সেই জন্যই ধ্যানমন্ত্রে কোথাও উল্লেখ না থাকলেও মূর্তিতত্ত্বে দেখা যায়, জগদ্ধাত্রীর বাহন সিংহ এক হস্তীর মৃত শরীরের উপর দাঁড়িয়ে। অন্যদিকে সংস্কৃতে হাতির অপর নাম করী, সেই অনুসারে অসুররূপি হস্তীটির নাম করীন্দ্রাসুর। তাকে বধ করে জগদ্ধাত্রীর অপর নাম হয় করীন্দ্রাসুরনিসূদিনী।