দেবতা না হয়েও কিছু পৌরাণিক চরিত্র ‘চিরঞ্জীবী’ হওয়ার বর পেয়েছিলেন। যার অর্থ তাঁদের প্রত্যেকেরই আয়ু হবে কয়েকশো বছর। এমনকি এইসময়ের মধ্যে জরা বা ব্যাধিও ছুঁতে পারবে না তাঁদের। বাস্তবে যা অমরত্বেরই সমতুল্য। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, কীভাবে এমন বর পেয়েছিলেন তাঁরা? আসুন, শুনে নিই।
‘জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে!’- এ পঙক্তি তাঁদের জন্য খাটে না। তাঁরা পুরাণের আট ব্যক্তিত্ব। পুরাণ মতে, বিশেষ কারণের জন্য এঁরা প্রায় অমরত্বের বর পেয়েছিলেন। তাই এই চরিত্রদের বলা হয় ‘চিরঞ্জীবী’। ‘চির’ মানে অনাদিকাল এবং ‘জীবী’ র অর্থ, যাঁরা বাস করছেন। সুতরাং ‘চিরঞ্জীবী’ শব্দটির অর্থ করলে দাঁড়ায়, যাঁরা অনেকদিন ধরে বেঁচে আছেন এবং থাকবেন। এই চরিত্রদের প্রত্যেকের জীবনকাল এক কল্পকাল। পুরাণ মতে এইরকম ‘চিরঞ্জীবীর সংখ্যা আট। তবে তাঁদের প্রত্যেকেই যে ভালো কাজের দরুন বর পেয়েছেন এমনটা নয়। এই আটজনের তালিকায় রয়েছে খলচরিত্রও। যাঁদের জীবনে অভিশাপ হিসেবেই ধরা দিয়েছে এহেন ‘অমরত্ব’।
আরও শুনুন: ১১৫ ফুট মন্দির তৈরি হল রাতারাতি, ‘ভূতের মন্দির’ এখনও শিহরিত করে পর্যটকদের
তাই তালিকার শুরুতেই বলতে হয় অশ্বত্থামার কথা। মহাভারতের অন্যতম খলচরিত্র অশ্বত্থামার জীবনে অমরত্ব ছিল অভিশাপ। মহাভারতের কাহিনী অনুযায়ী, অশ্বত্থামা পাণ্ডবদের পরবর্তী প্রজন্মকে ধংস করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তাই প্রথমে পাণ্ডবপুত্রদের হত্যা। তারপর অর্জুনের পুত্র অভিমন্যুর গর্ভবতী স্ত্রী উত্তরার গর্ভে থাকা সন্তানের উপর ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করেন অশ্বত্থামা। এহেন চরম অনৈতিক কাজের ফলেই ক্রুদ্ধ হয়ে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে এমন অভিশাপ দিয়েছিলেন। অভিশাপে বলা হয়েছিল মর্তের নিকৃষ্টতম দিনগুলিকেও স্বচক্ষে দেখতে হবে অশ্বত্থামাকে।
এরপর রয়েছেন দৈত্যরাজ বলি। হিরণ্যকশিপুর পুত্র বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের পুত্র ছিলেন বিরোচন নামের এক দৈত্য। সেই বিরোচনের পুত্র ছিলেন বলি। দৈত্যবংশে জন্ম হলেও পিতামহ প্রহ্লাদের গুণে বলি ছিলেন দারুণ ধার্মিক। কিন্তু তাঁর ছিল প্রবল দানধ্যানের স্বভাব। সেই স্বাভাবের বশেই তিনি বিষ্ণুর বামন অবতারকে সমগ্র ত্রিভুবন দান করে দেন। এমন মহান ত্যাগের কারণেই তাঁকে অমরত্বের বর দেন স্বয়ং শ্রী বিষ্ণু।
এবার বলতে হয় মহর্ষি বেদব্যাসের কথা। পুরাণমতে তিনিও ‘চিরঞ্জীবী’। সমগ্র মহাভারত ও তার এক বিশেষ অংশ হিসেবে শ্রীগীতার রচনা করেছিলেন তিনি। এমন বিরাট পাণ্ডিত্যের কারণেই তাঁকে ভগবান বিষ্ণু চিরঞ্জীবী হওয়ার বর দিয়েছিলেন। এরপর রয়েছেন পবনপুত্র হনুমান। শ্রীরামের একনিষ্ঠ ভক্ত হিসেবে হনুমান চরিত্রটি পুরাণে বেশ বিখ্যাত। রামায়ণ পড়লেই জানা যায় শ্রীরামের লঙ্কা বিজয়ের নেপথ্যে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাই তাঁর ভক্তিতে খুশি হয়ে স্বয়ং রাম তাঁকে ‘চিরঞ্জীবী’ হওয়ার বর দেন। কথিত আছে, যেখানেই রামনাম করা হবে বা রামভক্তির লক্ষণ দেখা যাবে, হনুমান সেখানেই গিয়ে বাস করবেন। রামায়ণের আরও এক ব্যতিক্রমী চরিত্র পেয়েছিলেন অমরত্বের বর। পুরাণ যাকে বিশ্বাসঘাতক বিভীষণ হিসেবে চেনে। রাবণ বধের পর লঙ্কার রাজসিংহাসনের বসার সুযোগ পান তিনি। একইসঙ্গে প্রভু রাম তাঁকে চিরঞ্জীবী হওয়ার বর দিয়ে বলেন আগামী দিনের পৃথিবীতে সত্যের প্রতিষ্ঠা করতে। এছাড়াও কৃষ্ণের বরে অমরত্ব পেয়েছিলেন কৃপাচার্য। বলা হয় কলি যুগের শ্রীকৃষ্ণের অবতার হিসেবে জন্ম নিতে চলা কল্কি অবতারকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার গুরু দায়িত্ব রয়েছে তাঁর কাঁধেই। তালিকার সপ্তম ‘চিরঞ্জীবী’ হলেন পরশুরাম। তিনিও নাকি ভগবান বিষ্ণুর মানব অবতার। জন্মগতভাবে ব্রাহ্মণ হলেও প্রবৃত্তিগত ভাবে পরশুরাম ছিলেন ক্ষত্রিয়। তিনিও অমরত্ব লাভ করেছেন কলিযুগের শেষে জন্ম নিতে চলা কল্কিকে যুদ্ধকলায় পারদর্শী করার জন্য। কথিত আছে, পরশুরামই হবেন কল্কির প্রধান গুরু। সবশেষে রয়েছে এক বালক। পরম শিবভক্ত বালক ঋষি মার্কণ্ডেয় ছিলেন ক্ষণজন্মা। কিন্তু স্বয়ং যমরাজ এসেও তাঁর প্রাণ হরণ করে নিয়ে যেতে পারেননি। কারণ তাঁর রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্বয়ং দেবাদিদেব মহেশ্বর। তাঁর প্রদান করা মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের জোরেই অমরত্বের বর পেয়েছিলেন মার্কণ্ডেয়।
আরও শুনুন: শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মস্থানেই তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ রূপ দিয়েছিলেন বাংলার প্রথম কালী বিগ্রহের
তবে এই আট চিরঞ্জীবীই নাকি বিষ্ণুর কল্কি অবতারের সঙ্গে যুক্ত। পুরাণমতে, এঁরা সকলেই কল্কিকে শিক্ষিত, সংগঠিত ও শক্তিমান করতে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করবেন।