একটিমাত্র ক্ষতচিহ্ন যে মানুষের মনে কতখানি ছাপ ফেলে যেতে পারে, সে কথা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলেন এই মানুষটি। বুঝেছিলেন, বাহ্যিক চেহারা দেখেই একজনকে নাকচ করে দিতে পারে কেউ কেউ। সেই হতাশাই তাঁকে এমন কিছু করার প্রেরণা জুগিয়েছিল, যাতে আর কাউকে তাঁর মতো পরিস্থিতিতে না পড়তে হয়। সেই ভাবনা থেকেই আবিষ্কৃত হয়েছিল আজকের সেফটি রেজর। আসুন, শুনে নেওয়া যাক সেই গল্প।
চেহারার উপরে মানুষের কোনও হাত নেই, এ কথা সত্যি। কিন্তু একসময় নিজের হাতেই প্রকৃতিদত্ত চেহারার বিকৃতি ঘটিয়ে বসতেন কেউ কেউ। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, দাড়ি কাটতে গিয়ে মুখের এদিকে ওদিকে নিত্যনতুন ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিতেন তাঁরা। আসলে, বিশ শতকের প্রথমদিকেও দাড়ি কামানোর একমাত্র যন্ত্র ছিল ক্ষুর। মনে করে নেওয়া যাক, সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী একটি কেসে খুনির সন্ধান পেয়েছিলেন সকলের দাড়ি কামানোর ক্ষুর পরীক্ষা করেই। কারণ খুন হয়েছিল সেরকম একটি ক্ষুর দিয়েই। তা এমন ধারালো যে অস্ত্র, গলার বদলে গাল পেলেও তার কাটতে বাধা কোথায়! আর ঠিক সেই ঘটনাই ঘটত অধিকাংশ লোকের ক্ষৌরকার্যের সময়। দাড়ি কামাতে গিয়ে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেত গাল। তার দরুন একদিকে মুখভর্তি খাপছাড়া দাড়িও থেকে যেত, আবার মুখমণ্ডলে স্পষ্ট হয়ে থাকত সেই ক্ষতচিহ্নও। সব মিলিয়ে মুখের চেহারাই যেত পালটে। আর এই কারণেই রীতিমতো সমস্যায় পড়েছিলেন এক ব্যক্তি।
আরও শুনুন: স্ত্রীর জন্মদিন ভুলে গেলেই হতে পারে হাজতবাস! কোথায় এমন নিয়ম রয়েছে জানেন?
পেশার দিক দিয়ে একজন সাধারণ সেলসম্যান ছিলেন তিনি। বাড়ি বাড়ি ঘুরে জিনিসপত্র বিক্রি করতে হত তাঁকে। কিন্তু মুখের এই হালের দরুন অনেক বাড়িতেই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হত তাঁর মুখের উপরে। সেই হতাশা থেকেই ওই ব্যক্তি ঠিক করেন, এর একটা সুরাহা করবেন তিনি নিজেই। দাড়ি কামানোর জন্য এমন এক যন্ত্র তৈরি করবেন, যা হবে ‘সেফ’ অর্থাৎ নিরাপদ। সেফটি রেজরের প্রাথমিক ধাপ শুরু হয়েছিল এইভাবেই।
আরও শুনুন: ঘুমের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাক! পোষ্য বিড়ালের তৎপরতায় প্রাণ বাঁচল মহিলার
কর্ক কোম্পানির সেলসম্যান হিসেবে কাজ করার সময় ওই ব্যক্তি দেখেছিলেন, বোতল খোলার পর তার মুখের কর্ক ছুঁড়ে ফেলে দেন ক্রেতারা। এখান থেকেই তাঁর মাথায় এসেছিল ‘ইউজ অ্যান্ড থ্রো’ অর্থাৎ একবার ব্যবহারযোগ্য জিনিস হিসেবে রেজর তৈরি করার কথা। সেক্ষেত্রে ক্ষুরের মতো বারবার ধার দেওয়ার ঝামেলা থাকবে না। সেইভাবেই, একটি স্ট্যান্ড ও একটি ব্লেডের সমন্বয়ে তাঁর কল্পিত যন্ত্রের নকশা বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। কিন্তু ১৮৯৫ সালে তৈরি এই নকশাকে বাস্তবে রূপ দিতে সময় লেগে গিয়েছিল আরও ছ-ছটা বছর। একে তো আনকোরা জিনিস, তার উপরে ‘ডিসপোজেবল ব্লেড’ বলে সস্তা করে বানাতে হবে, এত বায়নাক্কা মানতে রাজি হননি কেউই। অবশেষে যন্ত্রটি বানাবার চেষ্টা করতে সম্মত হলেন এমআইটির প্রযুক্তিবিদ্যার স্নাতক ছাত্র, উইলিয়াম নিকারসন। আর ১৯০১ সালে তাঁর হাত ধরেই প্রথম তৈরি হয় এই সেফটি রেজর। ‘জিলেট রেজর’ নামে আজও যাকে চিনি আমরা। কারণ এই যন্ত্রটির উদ্ভাবক ওই ব্যক্তির নাম ছিল কিং ক্যাম্প জিলেট। এই সেফটি রেজরের উদ্ভাবনই বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দেয় তাঁকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেনাদের নিরাপত্তার জন্য জিলেটের থেকে পাইকারি হিসাবে রেজর ও ব্লেড কিনেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কয়েক বছরের মধ্যেই সামান্য সেলসম্যান থেকে বিশ্বের অন্যতম ধনী শিল্পপতি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন জিলেট।