মৌলবাদী হামলার শিকার বুকারজয়ী সলমন রুশদি। ঘটনার পর থেকেই ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদ নিয়ে বিস্তর চর্চা শুরু হয়েছে। তবে বিশিষ্টমহল এবং নাগরিকদের একাংশ প্রতিবাদ করলেও এ নিয়ে কার্যত মুখে কুলুপ বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনের। তবে শেষমেশ মুখ খুলল ইন্ডিয়ান মুসলিমস ফর সেকুলার ডেমোক্রেসি। এই ধরনের হামলা যে ইসলামের পক্ষেই ক্ষতিকর, তা স্পষ্ট করে দিয়েছে সংগঠনটি। আসুন শুনে নিই তাঁদের বক্তব্য।
মৃত্যুভয় তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে সর্বদা। ‘দ্য সেটানিক ভার্সেস’ নামক বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই বদলে গিয়েছিল সলমন রুশদির জীবনটা। তাঁর প্রাণ নিয়ে পড়ে গিয়েছিল টানাটানি। ইরানের তৎকালী সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লা খোমেইনি তাঁর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে। এখনও পর্যন্ত যতজন প্রকাশক বা অনুবাদক ওই বইটি নিয়ে এগিয়েছেন, তাঁদের উপর কোনও না কোনও ভাবে হামলা হয়েছে। নিরাপত্তাবেষ্টনী থাকার পরেও ক্রমাগত পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে রুশদিকে। সেই ফতোয়ার তেত্রিশ বছর কেটে গেলেও পরিস্থিতি যে পাল্টায়নি এতটুকু, তা ফের প্রমাণ হয়ে যায় সাম্প্রতিক হামলায়। নিউ ইয়র্কের একটি অনুষ্ঠানে তাঁর উপর ছুরি নিয়ে চড়াও হয় এক যুবক। ঘটনার জেরে সম্ভবত একটি চোখ নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে রুশদির।
আরও শুনুন: ছদ্মনামে আত্মগোপন, মৌলবাদী ফতোয়ায় অন্তত ৫৬ বার বাড়ি বদল করেছিলেন রুশদি
ঘটনাস্থল থেকে রাতারাতি গ্রেপ্তার করা হয়েছিল হামলার নেপথ্যে থাকা হাদি মাতার নামে ওই যুবককে। হামলার কারণ স্পষ্ট। খোমেইনির জারি করা ৩৩ বছর আগের সেই ফতোয়া। এই যুবকও তাঁরই আদর্শে দীক্ষিত। অতএব বুকারজয়ী সাহিত্যিক রুশদিকে না-মারা পর্যন্ত শান্তি নেই তাঁর। এই ভয়াবহ ঘটনার পরে গোটা বিশ্বের নানা মহল থেকে স্বাভাবিক ভাবেই উঠেছে প্রতিবাদের ঝড়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ রাজনীতিক ও প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঋষি সুনক পশ্চিমের দেশগুলির কাছে ইরানের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার ডাক দিলেও সে ডাকে সাড়া দেয়নি খোদ ভারত। অথচ রুশদি নিজেও একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। এই ঘৃণ্য ঘটনার এখনও পর্যন্ত বিরোধিতা করেনি একটিও মুসলিম সংগঠন। আর সে বিষয়টিকে মোটেও ভাল চোখে দেখছে না ইন্ডিয়ান মুসলিমস ফর সেকুলার ডেমোক্রেসি (IMSD)।
ধর্মান্ধতার মোড়কে এই মৌলবাদের রাজনীতি আসলে মুসলিমদের আরও বেশি ক্ষতি করছে বলেই মত ফোরামটির। এত ভয়ঙ্কর একটা ঘটনার পরেও সমস্ত মুসলিম সংগঠন যেভাবে মুখে কুলুপ এঁটেছে, তা অকল্পনীয় বলেই মনে করছে তারা। এই ধরনের পদক্ষেপ ইসলামবিদ্বেষীদের মনে আরও বেশি করে সন্ত্রাস এবং হিংসার জন্ম দেবে। ফলে মুসলিম সংগঠনগুলির নিজেদের অবস্থান পুনরায় বিবেচনা করা উচিত বলেই মনে করছে তারা। তাদের এই বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন সমাজকর্মী মেধা পটকর, রাজনীতিবিদ যোগেন্দ্র যাদব, ম্যাগসাইসাই সম্মান-বিজেতা সন্দীপ পাণ্ডে-সহ দেশের ৬০ জন বিশিষ্ট মানুষ।
আরও শুনুন: বুকারজয়ী উপন্যাসেও অসহিষ্ণুতার খাঁড়া, বাতিল গীতাঞ্জলি শ্রী-র সংবর্ধনার অনুষ্ঠান
ভারত একটি স্বাধীন, সার্বভৌম এবং ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। যে দেশের সংবিধানের মূল কথাই ঐক্য। অথচ আজকের দেশের দিকে তাকালে সেই ব্যাপারগুলি খুঁজে পেতে বেশ কষ্টই করতে হয়। এই IMSD ভারতীয় মুসলিমদের নিয়ে তৈরি এমন একটি ফোরাম, যারা রাষ্ট্রপুঞ্জ নির্ধারিত মানবাধিকার ও দেশের সংবিধানের পক্ষে কথা বলে। আর রুশদির উপর এই বর্বর হামলার কড়া নিন্দা করেছে ফোরামটি। সম্প্রতি IMSD-র পক্ষে বিবৃতি দিয়ে এ কথা জানানো হয়েছে। তাদের বক্তব্য, এ ধরনের মৌলবাদী কাজকর্মই বিশ্ব জুড়ে মুসলিমবিদ্বেষ বাড়াতে সাহায্য করছে। মুসলিম সংগঠনগুলির উপর তোপ দেগে তারা আরও জানিয়েছে, এই সব সংগঠনগুলির একটি বড় অংশ মানবাধিকারের কথা তখনই মনে রাখে, যখন হামলার তিরটি তাদের দিকে এসে পড়ে। কিন্তু অন্যদের জন্য সেই সম্মান বা আবেগ কখনওই দেখা যায়না তাদের মধ্যে। আর দ্বিচারিতা আসলে মুসলিম ধর্মেরই বেশি ক্ষতিসাধন করছে বলেই সাফ জানানো হয়েছে ওই ফোরামের তরফ থেকে। যে বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টজনেরাও।