ফাঁসির আগে নাকি ক্ষুদিরাম জানতে চেয়েছিলেন, ফাঁসির দড়িতে মোম মাখানো হয় কেন। মৃত্যুর মুখে দাঁড়ানো তরুণের এহেন অকুতোভয় মনোভাব দেখে চমকে গিয়েছিল বিরোধী শাসক। আসলে এমন মৃত্যুঞ্জয়ী চেতনা নিয়েই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ক্ষুদিরাম আর তাঁর মতো আরও অনেকে। মৃত্যুকে একান্ত শান্তভাবেই গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা। আসুন, শোনা যাক তাঁদের কথাই।
“মৃত্যুটাকে আমরা এত বড় করিয়া দেখি বলিয়াই সে আমাদিগকে ভয় দেখাইতে পারে। এ যেন ছোট ছেলের মিথ্যা জুজুবুড়ির ভয়। যে মরণকে একদিন সকলেরই বরণ করিয়া লইতে হইবে, সে আমাদের হিসাবে দুই দিন আগে আসিল বলিয়াই কি আমাদের এত বিক্ষোভ, এত চাঞ্চল্য?”- ফাঁসির ঠিক ৭ দিন আগে কনডেমড সেল থেকে মাকে এ চিঠি লিখছেন এক ২০ বছরের তরুণ। যাঁর নাম দীনেশ গুপ্ত। বিনয়-বাদল-দীনেশ ত্রয়ীর সেই তরুণ তুর্কি, রাইটার্স বিল্ডিংয়ে অলিন্দ যুদ্ধের বীর সৈনিক দীনেশ গুপ্ত।
আরও শুনুন: ব্রিটিশের পতাকায় ভারতের পরিচয় নয়, বিদেশের মাটিতে দেশের ‘জাতীয় পতাকা’ উত্তোলন তাঁর হাত ধরেই
একা দীনেশই নন। জেলখানা থেকেই মাকে দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আরেক তরুণ, উনিশ বছরের প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য। মেদিনীপুরের কুখ্যাত জেলাশাসক রবার্ট ডগলাসকে হত্যা করে হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছিলেন তিনি। মা পঙ্কজিনী দেবীকে লেখা সেই চিঠিতে প্রদ্যোৎ লেখেন, ‘আজ একটা আদর্শের জন্য প্রাণ বিসর্জন করছি, তাতে আনন্দ আমার মনের কানায় কানায় ভরে উঠেছে, মন খুশিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। …মা, তোমার প্রদ্যোৎ কি কখনো মরতে পারে! আজ চারদিকে চেয়ে দেখ, লক্ষ লক্ষ প্রদ্যোৎ তোমার দিকে চেয়ে হাসছে।’
মেদিনীপুরের আরেক অত্যাচারী জেলাশাসক বার্জকে হত্যা করেছিলেন ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, নির্মলজীবন ঘোষ এবং রামকৃষ্ণ রায়। বিচারে ফাঁসির আদেশ হয় তিনজনেরই। ফাঁসির চার দিন আগে রবীন্দ্রনাথের ‘শেষ বিদায়’ কবিতার পঙক্তি সামান্য বদল করে চিঠিতে তুলে আনছেন একুশ বছরের ব্রজকিশোর, ‘আমার মা, মা আমার, প্রণাম নিন।… ভোরের বেলা শূন্য কোলে/ ডাকবি যখন ‘বেজা’ বলে/ বলবো আমি— নাই গো ‘বেজা’ নাই, মাগো যাই।’ আর রামকৃষ্ণ রায় লিখছেন, ‘মা, আজ আমার হৃদয়ে কী সুখ যে অনুভব করছি তা আমি নিজেই বুঝতে পারছি না।’
আরও শুনুন: স্বাধীনতার সকালে উর্দু খবর শুনিয়েছিলেন সইদা বানো, দেশের প্রথম মহিলা সংবাদপাঠিকা তিনিই
একইরকম আনন্দের অনুভূতিকে চিঠিতে প্রকাশ করেছিলেন বিপ্লবী ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য। দার্জিলিঙে লেবং রেস কোর্সে ছোটলাট জন অ্যান্ডারসনকে গুলি ছুড়তে গিয়ে ধরা পড়ে যান একুশ বছরের ভবানীপ্রসাদ। মৃত্যুর তিন দিন আগে ছোটভাই দুর্গাপ্রসাদকে তিনি চিঠি লিখেছেন: ‘অমাবস্যার শ্মশানে ভীরু ভয় পায়— সাধক সেখানে সিদ্ধিলাভ করে।… আজ আমি বেশি কথা লিখব না, শুধু ভাবব। মৃত্যু কত সুন্দর! অনন্ত জীবনের বার্তা তার কাছে।’
বয়স যত কমই হোক, মৃত্যুকে এক ঋষিপ্রতিম নির্লিপ্তির সঙ্গে বরণ করে নিয়েছিলেন এই বিপ্লবীরা। মৃত্যু নিয়ে কোনও দার্শনিক উপলব্ধির কথা প্রকাশ না করেও ফাঁসির আগে সহকর্মীদের উদ্দেশে এক আশ্চর্য চিঠি লিখে যান ভগৎ সিং-ও। তাঁকে সাহসের সঙ্গে ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে দেখে দেশের মায়েরা উদ্বুদ্ধ হবেন, তাঁদের সন্তানদের দেশের কাজে নিয়োজিত করবেন, আর তাদের সকলের মিলিত শক্তির সামনেই মাথা নোয়াবে শাসক, এই ছিল তাঁর আশা। আর সেই আশা বুকে নিয়েই তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমার চেয়ে বেশি ভাগ্যবান আর কে হতে পারে!’
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “আমি মৃত্যু চেয়ে বড়, এই কথা বলে/ যাব আমি চলে’। সেই কথাকেই নিজেদের জীবনে সত্যি করে তুলেছিলেন এই অকুতোভয় বিপ্লবীরা। সেই সাহসের সামনে মাথা নুইয়েছিল খোদ মৃত্যুও।