এত মায়া, এত দরদ, গানের ভিতর দিয়ে নির্জন একাকীর যে ইন্দ্রিয়ঘন পথচলা- নির্মলার গান বরাবরই বেভুল পথ-হারানো বাঙালির কাছে তার হারানো পথের উজ্জ্বল মাইলফলক।
ভুবনায়নের মোহমদ তখনও এ-বাংলার মাটিকে তেমন নেশাতুর করে তোলেনি। সেই বাংলার মাটিতে কান পাতলে শোনা যেত এক অপূর্ব আকুতি- ‘এই বাংলার মাটিতে মা গো জন্ম আমায় দিও’। জীবনানন্দীয় ‘আবার আসিব ফিরে’র ব্যঞ্জনার সঙ্গে যে-বাঙালির পরিচয় হয়নি সেভাবে, তিনিও মোহিত হতেন; শুধু কথার গুণে বা সুরের মূর্ছনায় নয়, মন্ত্রমুগ্ধ হতেন ওই গায়কির মায়াবী জাদুতে। নির্মলা মিশ্র আসলে এক ঐশ্বরিক জাদুকণ্ঠ, বাঙালি ও বাংলা গান যাঁকে পায় একবারই।
আরও শুনুন: ‘আপনার ফ্লোরে থাকা দরকার’ জ্বরে কাতর তরুণ মজুমদারের পাশে দাঁড়ালেন স্বয়ং সুচিত্রা
শ্রোতার অনুভবের উপর নির্মলা মিশ্রর গান যে-মায়া ছড়িয়ে দিতে পারে, কয়েক দশক যাবৎ বাঙালি বাঁধা পড়েছে সেই মায়াডোরেই। নির্মলার জাগতিক জীবনের অধ্যায় শেষ হলেও, সে-ডোর ছিন্ন হয় না। অথচ ধ্রুপদী সঙ্গীতের জগতের নির্মলার হয়তো আধুনিক গানের জগতে আসাই হত না, যদি না শারীরিক অসুস্থতা হয়ে উঠত অমোঘ নিয়তি। এখন মনে হয়, সুরের দেবতার সে ছিল এক অপূর্ব ছলনা। নির্মলার সেজদা, কানু মিশ্র সেদিন জেদ না করলে হয়তো বাংলা আধুনিক গানের প্রাপ্তির ভাঁড়ার অস্পম্পূর্ণই থেকে যেত। হৃদরোগের কারণে, ডাক্তার নিষেধ করেছিলেন গানবাজনা করতে, বিশেষত শাস্ত্রীয় সংগীত। ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের কোলেপিঠে বড় হয়েছে যে মেয়ে, এগারো-বারো বছরের সেই মেয়েটা তাহলে থাকবে কী নিয়ে? কিন্তু মেয়ে শাস্ত্রীয় সংগীত ছাড়া অন্য গান গাইবে, এই ব্যাপারে নির্মলার বাবা, পণ্ডিত মোহিনীমোহন মিশ্র, ছিলেন গররাজি। কানু মিশ্র ফিরে গেলেন সুরের একেবারে গোড়ায়, প্রশ্ন করলেন, সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি ছাড়া তো কোনও সঙ্গীত হয় না, তাহলে আপত্তি কীসের? এই শুনে ভাগ্যিস পণ্ডিতজি মত দিয়েছিলেন। বাংলা সংগীতের জগতের সেদিনই হয়েছিল অভূতপূর্ব প্রাপ্তি।
আরও শুনুন: ‘নিজে ছবি ডিরেক্ট করছেন না কেন?’ সিনেমাপাড়ার তরুণকে পরিচালনায় আসার ডাক উত্তমকুমারের
আধুনিক গানের ভুবনে এসে একলব্যের মতোই নচিকেতা ঘোষকে দ্রোণাচার্য স্বীকৃতি দিয়েছিলেন নির্মলা। নচিকেতা ঘোষের গান গাওয়া, সুরের কারুকাজ ছুঁয়ে ছুঁয়ে নির্মলা দেখতে পেতেন অজস্র ছবির কোলাজ। সুরে সুরে ছবি আঁকার সেই শিল্পকে, উত্তরকালে অন্য এবং অনন্য মাত্রা দান করেছিলেন নির্মলা। ছায়াছবির গান নয়, সেই অর্থে যে-গানের সঙ্গে কোনও দৃশ্যের মায়া বুনে দেওয়া হয়নি, সেই গানেও নির্মলা তৈরি করতে পারতেন অপূর্ব চিত্রকল্প। এই গানের মাধুর্য স্পর্শ করতে গেলে অবশ্য পুরনো দিনের সিন্দুকই খুলতে হয়। সেই ‘অনুরোধের আসর’ কিংবা শনিবারের পাড়ার জলসার দিনকাল, যখন গান কেবলই শ্রাব্য, দৃশ্যমাধ্যমের ‘ইভেন্ট’ হয়ে ওঠেনি, তখন নির্মলার অভূতপূর্ব কণ্ঠের সাম্পান বাঙালি শ্রোতাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত কল্পনার দরিয়ায়। বাঙালি সেদিনও কেবল সুরে সুরে ভেসে যেতে দ্বিধা করত না। সুরের মায়ায় এই যে দৃশ্য রচনা তো ছিল বাংলা গানের ঐশ্বর্য। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্রের মতো প্রবাদপ্রতিম শিল্পীরা, তাঁদের গায়কির চলনে এই কল্পনার উৎসারকে বাস্তব করে তুলতে পারতেন। পারতেন নির্মলাও।
আধুনিক গানে তাঁর আর-এক প্রেরণা ছিলেন উৎপলা সেন। সলিলের প্রান্তরের গান হারিয়ে যাওয়া, মেঠো সুরের গান মিলিয়ে যাওয়ার যে অন্তর্নিহিত বিষাদ, উৎপলা তাঁর কণ্ঠে ধরে রেখেছিলেন, এ জগতে বোধহয় তার দ্বিতীয় তুলনা খুঁজে পাওয়া যায় না। ‘ক্লান্ত ডানায় নীড় খুঁজি/ অথৈ নদীর তীর খুঁজি’- উচ্চারণের সময় উৎপলা সেন যেভাবে রাজনৈতিক ও ব্যক্তির বিধুরতাকে স্পর্শ করেন, বাংলা গানে তা এক স্মরণীয় পাঠ্য। আর নির্মলা যখন গেয়ে ওঠেন, ‘এমন একটা ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’, সেই গানে প্রতিবার ‘পেলাম না’ উচ্চারণে তিনিও স্পর্শ করতে পারেন সেই আশ্চর্য বিধুরতা। ব্যক্তির বিষণ্ণতাকে তিনি চারিয়ে দিতে পারেন সমগ্রতায়। আবার প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘মা গো আমার শোলোকবলা কাজলাদিদি কই’ উচ্চারণের সময় যে নীরব আর্তনাদকে তুলে আনেন, সেই একইরকম বুক মোচড়ানো অস্ফুট কষ্টের মালা গাঁথেন নির্মলা, যখন তিনি গেয়ে ওঠেন, ‘ও তোতাপাখি রে…’। সুরের সহজ চলনের ওপর ভাবের এই খেলা, নির্মলা গানের গায়ে এঁকে দিতে পারতেন অনায়াস দক্ষতায়। এমন এক সময় ছিল, যখন উৎসবে, অনুষ্ঠানে, পুজোর প্যান্ডেলে নির্মলার আধুনিক গান বাঙালি শ্রোতাকে ফিরিয়ে দিত তার শিকড়ে। আলাদা করে বাঙালির কথা বারবার বলতে হয়, কারণ, নির্মলা ওড়িয়া, মারাঠি-সহ গান গেয়েছেন বহু ভারতীয় ভাষাতেও। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অগাধ ব্যুৎপত্তির কাছে ভাষা হয়তো বাধা নয়। কিন্তু নির্মলার শ্রেষ্ঠত্ব এইখানে যে, ভাষার ব্যবধান পেরিয়েও, তাঁর গায়কিতে নির্মলা শ্রোতাকে অনুভবের যে ঘনতায় পৌঁছে দিতে পারতেন, তা তুলনারহিত। আর এইখানেই বাঙালির হারিয়ে ফেলা পোস্টকার্ড যেন নির্মলার গান। যে গানে রাখা আছে তার রেডিওর গান-শোনার সন্ধে; যে গানে রাখা আছে কনে-দেখা-আলোয় গান গেয়ে ওঠা কোনও সলাজ কিশোরীর একান্ত আবেগের মুহূর্ত; যে-গানে বাঙালি ফিরে যেতে পারে তার মোকামে, আত্মপরিচয়ে। এত মায়া, এত দরদ, গানের ভিতর দিয়ে নির্জন একাকীর যে ইন্দ্রিয়ঘন পথচলা- নির্মলার গান বরাবরই বেভুল পথ-হারানো বাঙালির কাছে তার হারানো পথের উজ্জ্বল মাইলফলক। পরিবর্তনের নিয়মে জগৎ বদলেছে, গানের ভুবনেও লেগেছে পালটা হাওয়া। তবু যেখানে যতবার বেজে ওঠে নির্মলার গান, বাঙালি যেন জন্মযানে ফিরে যায় তার নিমগ্ন দিনকালে। মাধুর্যময় যাপনের সঙ্গে লগ্ন হয়ে আছে যে-গান, তা যুগ অতিক্রম করেও আধুনিক। নির্মলা তাঁর গানকে সেই আধুনিকত্বে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন বহুকাল আগেই।
নির্মলা মিশ্রর ডাকনাম ‘ঝামেলা’, এ কথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু কে না জানে, এ ‘ঝামেলা’ বাঙালির বড় আদরের। আগামীর শ্রোতা, যদি শ্রোতাপরিচয়কেই শিরোধার্য করেন, তবে হাসিমুখে বরণ করে নেবেন এই ‘ঝামেলা’কে- নির্মলা মিশ্র ও তাঁর সংগীতকে।